শেষ বিকেলের রোদ্দুর
কুরআন কারিমের সৌভাগ্যবান পাঠকমাত্রই অবগত আছেন যে, কোনো দর্শন এবং চিন্তা-চেতনা মানুষের দোরগোড়ায় এবং তাদের হৃদয়ের গভীরে পৌঁছানোর সবচেয়ে সফল ও প্রজ্ঞাপূর্ণ মাধ্যম হলো গল্প। আর সেসব গল্প যখন বিবৃত হয় কুরআন-হাদিসের মিশেলে তখন সেগুলো হয়ে ওঠে আরও অনুসরণীয়, শিক্ষণীয় এবং মহিমান্বিত।
‘শেষ বিকেলের রোদ্দুর’ রৌদ্রময়ীদের এমনই একটি জীবনঘনিষ্ঠ গল্পভাষ্য, যেখানে কুরআন-হাদিসের মিশেলে আমাদের জীবনের বাস্তব গল্পগুলোই ঝিলমিলিয়ে ওঠেছে।
গল্পগুলোর বুনন এতটা সুঠাম ও বস্তুনিষ্ঠ যে, গল্পের চরিত্র ও জীবনপরিক্রমা যেন আপনি নিজের জীবনে প্রত্যক্ষ করছেন। গল্পগুলোর আরেকটি সৌন্দর্য হলো, সেগুলো বিবৃত হয়েছে নানা আঙ্গিকে, বিভিন্ন নামে ও শিরোনামে।
বি:দ্র: শেষ বিকেলের রোদ্দুর বইটি free pdf download করিতে চাহিয়া লেখকদের নিরুৎসাহিত করিবেন না
Md Yasir Irfan –
শেষ বিকেলের রোদ্দুর
তোকে আগেও অনেক বইয়ের গল্প বলেছি। তোর জন্য অবশ্য-পাঠ্য বলেছিও অনেক। নারী-লেখক ও নারীবাদ যদি হয় বইয়ের বিষয়বস্তু, সেক্ষেত্রে খুব জোরও দিয়েছি। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, আশাপূর্ণা দেবীর ‘বকুল-কথা’ ও ওরিয়ানা ফাল্লাচির ‘লেটার টু চাইল্ড নেভার বর্ন’ দুটি বইয়ের কথা। এখন যে বইটার গল্প করতে যাচ্ছি—একগুচ্ছ নারী-কলম দ্বারা পরিপূর্ণ তা। বইয়ের নাম—শেষ বিকেলের রোদ্দুর; সাংসারিক খুঁটিনাটি, দাম্পত্য সম্পর্ক, আত্ম-শুদ্ধি, নারীবাদ, জীবন-দর্শন সহ চমৎকার সব চিন্তা আর গল্পের সুন্দরতম সম্মিলন ঘটেছে এখানে।
আমার একটা ব্যাপার মনে হয়, নারীরা যেকোনো ব্যাপার যতটা সুন্দর ও গোছালোভাবে ভাবতে পারে—পুরুষরা সেভাবে পারে না। একটা গল্প, একটা ঘটনা, নারীর শক্তিশালী লেখনী পেলে যেভাবে উঠে আসে—পুরুষ লেখক যতই শক্তিশালী হোন, তিনি হয়তো ঠিক সেরকম পারেন না। এই বইটা আমার সে উপলব্ধি আরো পাকাপোক্ত করেছে।
একটা গল্পের কথা অবশ্যই বলব। দ্য ম্যান হু লাফস। একজন শায়খ ও বিয়ের পিঁড়িতে বসা এক তরুণীর চিন্তাভাবনা নিয়ে সাজানো গল্পটা। শায়খ—আমাদের খুব পরিচিত একজন মনে হয়। গল্পে সরাসরি বলা হয়নি, তবে অনুমান করতে পারি, রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়া গল্পের শায়খের সঙ্গে আমাদের পছন্দের একজন শায়খের জীবনও মিলে যায়। যেহেতু গল্পের শেষে ‘সব চরিত্র কাল্পনিক হয় না’ বলা হয়েছে, সে হিসেবে আমরা ধরে নিতে পারি—গল্পের তরুণীও কাল্পনিক কেউ নন।
পারিবারিক সম্পর্কগুলো খুব সুন্দরভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। শাশুড়ির সঙ্গে সম্পর্ক, রান্নাঘরে দু’জনের রসায়ন সহজ ও সাধারণ করার দারুণ কিছু উপকরণ পাবি এখানে। বই পড়া নিয়েও বলা হয়েছে। অনেকেই বই পড়তে চায় না, বইয়ের জন্য সময় খুঁজে পায় না, আবার কেউ আগ্রহ পায় না, খুব সুন্দরভাবে সময় ব্যবস্থাপনা ও বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর উপায় আলোচিত হয়েছে এখানটায়।
মহান প্রভুর সঙ্গে আমাদের অনেকের দূরত্ব বেড়ে যায়, আবার মহান প্রভুর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গেলে বাবা-মা, সমাজ-স্বজন ঘেরা এক পরিমন্ডলের নানান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীনও হতে হয়। ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির গল্পের রুপায়ন এখানে আমাদের সেসব চ্যালেঞ্জ মুকাবিলার প্রেরণা হতে পারে।
তোর বিয়ের পর আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেছিল, তুই চাকরি করবি কিনা? আমি জবাবে বলেছিলাম, করতেও পারিস। তবে চাকরিতে তোর আগ্রহ কম। শুনে তাদের পালটা প্রশ্ন ছিল, তাহলে এত পড়াশোনা করে লাভটা কি হলো?
আমি হেসেছিলাম। জবাব দিইনি। কারণ, প্রশ্নকর্তারা কেউ যদু-মধু নন। বেশ ডিগ্রীধারী আছেন। এখন না বুঝলেও, একসময় বুঝবেন—সে আশা রাখি। আমাদের সমাজ ও সমাজের অনেক মানুষ পড়াশোনা ও চাকরি—দুটকে সমার্থক ভাবেন। অথচ পড়াশোনার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তো কিছুতেই চাকরি হতে পারে না। আবার অনেকে সংসার-মাতৃত্ব-বাচ্চা পালন এসবকে খুবই তুচ্ছ ভাবেন। কিন্তু কোট করার সময় বেশ গম্ভীর স্বরে বলেন, নেপোলিয়নের সেই অমর উক্তি—আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো।
শিক্ষিত মা—এটা বিশাল গুরুত্ব বহন করে। মানুষ বুঝুক বা না বুঝুক।
‘গৃহিণী না চাকরিজীবি?’ আলোচ্যে খুব সুন্দরভাবে আলোচনা করা হয়েছে ব্যাপারগুলো। খুবই যৌক্তিক একটা প্রশ্নও রাখা হয়েছে, ‘যদি বলা হয় পড়াশোনাকে কাজে লাগানোর কথা তাহলে বলতে পারেন আমাদের দেশের কতজন মানুষ যে বিষয়ে পড়েছেন সেই বিষয়ের ওপরই চাকরি করছেন? একজন শিক্ষিত সচেতন নারী যেভাবে ঘর পরিচালনা করবেন, সন্তান প্রতিপালন করবেন একজন অল্প শিক্ষিত উদাসীন মা কি সেভাবে পারবেন?’
তোর জন্য আরো একটু কোট করে দিচ্ছি, ‘যে মা বাচ্চাকে মোবাইল হাতে দিয়ে খাওয়ান আর যে মা গল্প শুনিয়ে খাওয়ান তারা কী একই ভ্যালু এ্যাড করছেন সমাজে? সন্তানের প্রথম উপুড় হওয়া, প্রথম একলা বসতে পারা, প্রথম হাঁটা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার মাঝে, সন্তানকে পূর্ণ দুই বছর বুকের দুধ খাওয়াতে পারার মাঝে যে তৃপ্তি আর না পারার মাঝে যে আফসোস তার খবর কি আমরা যারা দেশের জিডিপিতে নারীদের বাইরে কাজ করিয়ে ভ্যালু অ্যাড করাতে চাই তারা রাখি?’
আমাদের শিশু, আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের সংসার, আমাদের পারিবারিক বন্ধন আরো সুদৃঢ় করতে এখানকার গল্পগুলো, এখানকার চিন্তাগুলো সহায়ক হবে বলেই বিশ্বাস। আমাদের চিন্তার ক্ষেত্র, আমাদের দেখার ভঙ্গি, জীবনকে যাপনের স্ট্যাইল একটু হলেও ভাবনার প্রশ্নের মুখে পড়বে। এবং সেই প্রশ্নের পর সমাধান খোঁজার যাত্রাটাও আশা করি আখেরে আমাদের জন্য, আমাদের সমাজের জন্য, আমাদের আত্মশুদ্ধির ক্ষেত্রে ভালো ফলাফলই বয়ে আনবে, ইনশাআল্লাহ।
রৌদ্রময়ীরা আগেও দুটি বই লিখেছেন। প্রথমটির নাম ছিল—রৌদ্রময়ী। পরেরটি—মেঘ রোদ্দুর বৃষ্টি। আর এই তৃতীয়টি—শেষ বিকেলের রোদ্দুর। প্রত্যেকটাতেই জীবনের নানাধাপ উঠে এসেছে, গল্পে-আলোচনায়। নারী-রচনায় নারীকেন্দ্রিক চরিত্রের সম্মিলন হলেও পুরুষদের জন্যেও দারুণ সহায়ক এই বই। কারণ, স্বাভাবিকভাবেই সমাজটা নারী-পুরুষে পরিপূর্ণ। এবং নারীর আলোচনা শুধুই ‘নারী’-তে আবদ্ধ থাকতে পারে না। তবে ব্লেইম গেইম নেই একদমই, পুরুষ হ্যান-ত্যান, স্বার্থপর, লোভী, দুশ্চরিত্র এসব নেই মোটেও। বরং নারী-পুরুষ দু’জনের সমন্বয়ে কীভাবে সংসার ও সমাজ, শুদ্ধ ও সুন্দর হয়—রয়েছে সে আলাপ।
তবে একটা ব্যাপার নিয়ে বলার আছে একটু। এখানকার নারী-চরিত্র অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তরুণী বা সদ্য বিবাহিতা বা ছোট বাচ্চার মা। শাশুড়ি ও মায়ের আলোচনা এলেও মূখ্য চরিত্র সেই কন্যা বা পুত্রবধু-ই। এখানে একটু নজর দেয়া গেলে মন্দ হয় না। খুব সম্ভব লেখিকাদের অধিকাংশই একটা নির্দিষ্ট বয়সের বলেই এটা হয়। হতে পারে, নাও হতে পারে। তবে আমরা যখন বইগুলো আমাদের বোনদের রিকমেন্ড করবো, একই সাথে চাইবো যেন মা-দেরও করতে পারি। অবশ্যই এটাতেও আমাদের মায়েরাও দারুণভাবে আলোড়িত হবেন। তবে এখানে বোনেরা যেরকম নিজের আয়না খুঁজে পেতে পারেন, মায়েরা বোধহয় ঠিক সেরকম পাবেন না। রৌদ্রময়ী টিম এটা নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করবে—এই আশাবাদ।
তোর হাতে বইটা পড়লে একদম প্রথমে পড়ার জন্য কয়েকটা গল্প বলে দিই। আশা করি বইয়ের সঙ্গে একাত্ম হতে এসব সাহায্য করবে তোকে।
অন্তরণ ও অনুরাগ। কুররাতা আইয়ুন। গৃহিণী না চাকরিজীবী? শাশুড়িরাও মানুষ। ভালোবাসার গল্প।
ভালোবাসার গল্প—এটা কিন্তু দুই বন্ধুর গল্প। দুটো ছেলের গল্প। উপরেই বলেছি না, নারীরা খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে গল্প করতে পারে, এই গল্পটা তার প্রকৃষ্ট উদাহারণ।
বই যদি তোকে মহান প্রভুর আরো কাছাকাছি হতে বিন্দুমাত্রও সাহায্য করে, কুপ্রবৃত্তির প্ররোচনায় নেমে আসা হতাশা দূর করতে একটু হলেও সহায়ক হয়, মাতৃত্ব ও সংসার উপভোগ করতে উদ্বুদ্ধ করে আরো—তাহলে মুনাজাতে অধমকে স্মরণে রাখিস।
ইতি—
ভাইয়া