জীবনের খেলাঘরে
জীবনের খেলাঘরে নামক বইটি বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলেম, সাংবাদিক, লেখক মুহিউদ্দিন খান সাহেবের আত্নজীবনী। তবে বইটা তিনি নিজেই লিখেছেন তাই এটা পূর্ণাঙ্গ জীবনী নয়। তাঁর শৈশব থেকে গ্রামে বেড়ে উঠা, পড়ালেখা, ঢাকায় পরবর্তী জীবনের অধিকাংশ ঘটনাই তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। বইটা পড়ে এতটাই তাজ্জব হয়ে গেছি যে শেষ করে কিছু না লিখলে মনে শান্তি পাব না । জীবনে এর মত আর কোন বই পড়িনি যা আমাকে একই সাথে প্রচুর প্রাপ্তি দিয়েছে আবার কিছু হারানোর শোকে কাঁদিয়েছেও।
দেশভাগের পূর্বাপর অবস্থাটা ছিল মুসলমানদের জন্য খুবই নাজুক একটা অবস্থা। প্রকৃত ইসলাম মেনে চলাটা সকল জাগতিক বিষয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মত, যেমনটা আজকের যুগেও প্রতীয়মান হয়। দেশভাগের আগে হিন্দু জমিদাররা মুসলমান কৃষকদের মানুষই মনে করত না। ইংরেজদের উচ্ছিষ্ট ভোগী জমিদাররা মানুষ ভাবত তাদেরই যারা ইংরেজদের শিক্ষায় শিক্ষিত, তাদের বেশভূষায় পরিবৃত, মুসলমান শিক্ষিতদের মাঝে তখন সাহিত্যচর্চা ছিল আরোও করুণ, কোন মুসলমানের লেখা তখনিই স্বীকৃত হত যখন বাবুরা বলত আরে এটা তো মুসলমানের লেখা বলে মনেই হচ্ছে না! আর এর বাইরে মুসলমানের সব লেখাই তখন সাহিত্যের নিচুস্তরে গণ্য হত। ৫০ দশকের পর মুহিউদ্দিন খান সাহেব যখন সাপ্তাহিক পাসবান ও সাপ্তাহিক ‘আজ’ এর এডিটর তখন ড. এনামুল হকের ‘মুসলিম বাংলা সাহিত্য’ নামক একটি বই নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বইটিতে পরিবেশিত অনেক তথ্যই ছিল বাবু ঐতিহাসিকদের দেওয়া বিকৃত তথ্যের নকলনবিসি মাত্র। মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, কবি ফররুখ আহমদ, কবি তালিম হোসেন, কবি বেনজির আহমদরা ছিলেন সমসাময়িক। তারা প্রায়ই সাপ্তাহিক ‘আজ’ এর অফিসে আড্ডা বসাতেন। এদের মাধ্যমেই ড. এনামুল হক রচিত ‘মুসলিম বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক সমালোচনা হয়। যার কারণে বইটির ২য় সংস্করণ বের হয়নি । শওকত ওসমানের ‘ক্রিতদাসের হাসি’ উপন্যাসটি যখন আদমজী পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয় তখনও সাপ্তাহিক ‘আজ’ বইটির সমালোচনা করতে ছাড়েনি। কারণ বইটিতে সুক্ষ্ণভাবে মুসলমানদের উপর আঘাত করা হয়েছে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেমন বলেছেন “ইংরেজরা এ উপমহাদেশে যে গোলামীর ধারা তৈরি করে দিয়েছে তা আজীবনেও শোধরাবে না।
আসলেও তাই, পাকিস্তান হওয়ার পর ইংরেজদের তৈরি করা আমলা শ্রেণীটিই তখন নেতৃত্ব হাতানোর নেশায় পাগল হয়ে ছুটে এসেছিল আর ওদিকে ভারতীয় নেতারা চুক্তির মুখালেফ হায়দ্রাবাদ, ভূপাল, মানভাদরের মতন মুসলিম রাজ্য গুলি দখল করে নিতে থাকে সেদিকে তাদের কোন খবরও ছিল না। ফলে পাকিস্তান যে উদ্দেশ্য নিয়ে জন্ম নিয়েছিল তার কোনটাই বাস্তবায়নের আলোয় মুখ দেখেনি। যার কারণে ২০ বছর যেতে না যেতেই আবার ভাঙ্গন! জীবনের খেলাঘরে বইটিতে খান সাহেব শুধু ইতিহাসের চর্চাই করেননি, বিশেষ একশ্রেণীর চাটুকার লোকদের মুখোশও উন্মোচন করেছেন।
তদানীন্তন মুসলমান ও আলেম উলামারা যখন সিপাহি বিপ্লব শতবার্ষিকী উদযাপন করছিলেন তা একদল ছদ্মবেশী বামপন্থী লোকদের পছন্দ হয়নি। এই ছদ্মবেশী বামপন্থীরা পাকিস্তানের আমলা বুর্জোয়াদের উচ্ছিষ্ট ভোগী হয়ে ইসলামের মূল মূল পিলারগুলির উপর আঘাত করতে থাকে। এরা সিপাহি বিপ্লব উদযাপন সহ্য করতে না পেরে সৃষ্টি করে রবীন্দ্রনাথ জন্মশতবার্ষিকী। কিন্তু ওদের জানা ছিল না ইংরেজদের দেশীয় দোসর বেনিয়া পরিবারের সন্তান রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পূর্ব বঙ্গের মুসলিম কৃষক শ্রেণীর রক্তচোষা কাপালিক চরিত্রের জমিদার । সারাজীবন তিনি জমিদারি করে রক্ত শোষণ করে গেছেন।
যেমন খান সাহেব ২০৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, আমি তখন অনেকটাই অপরিণত, তারপরও আল্লার উপর ভরসা করে মুরুব্বীদের দেখানো পথে সাপ্তাহিক ‘আজ’ কে প্রতিরোধ সংগ্রামে নিয়োজিত করলাম। কবি বেনজির আহমদ, কবি ফররুখ আহমদ, ড. হাসান জামান খান, ড. আশকার ইবনে শাইখ, দেওয়ান আব্দুল হামিদ, কবি মাহমুদ লশকর, কবি ফারুখ মাহমুদ প্রমুখের নেতৃত্বে একদল বিদগ্ধ কলম সৈনিক লেগে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ যে একজন ভয়ানক শোষক ছিলেন, কট্রর মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন, মুসলমানদের কে মোটেও ভাল মানুষ বলে মনে করতেন না এসব তথ্য দলিল প্রমাণ সহ উপস্থাপন হতে লাগল।
আমার অনেক সময়ই মনে হত এ দেশে এখন অবদি সঠিক ইসলাম পৌঁছেনি। খান সাহেব যেন সেই ভাবনাটারও কিছু ব্যাখ্যা দিলেন।
তার একটা কারণ বাংলায় কিছু দু’মুখো মানুষ ছিল যাদের দ্বারা দেশের বিশাল একটা শ্রেণী আজও প্রভাবিত।
যেমন তিনি ২১১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন
পাকিস্তান আমলের আইয়ুবী শাসনামলে শওকত ওসমান, শামসুর রহমান, মুনীর চৌধুরী, কবির চৌধুরী সুফিয়া কামাল গংরা ছিলেন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ প্রীতিভাজন, এরা উপরেরটা খেতেন নিচেরটাও কুড়াতেন এদের পিছনে প্রশাসনিক খুঁটির জোর ছিল। আর ফররুখ আহমদের দল ছিল লকিড়কা ফকির। তবে হিম্মতের কমতি ছিল না । কিন্তু তারপরও আমরা লড়েছিলাম আর আল্লাহর রহমতে সফলতাও লাভ করেছিলাম,
শওকত ওসমানেরা ৪৭ এর সময় দেশে আমদানি হয়েছিলেন। এই নামটাও নাকি তাঁর আসল নাম না । দু নম্বরি, অতিপাকিস্তানী বনার উৎসাহে পিতৃদত্ত নাম পাল্টিয়ে তখন অনেকেই পাঞ্জবীদের পছন্দনীয় নাম রেখেছিলেন। এরা হিন্দুদের লাথি গুঁতা খেয়ে এ দেশে ছিটকে পড়েছিলেন। কানমে বিড়ি মুহমে পান লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান শ্লোগান দিয়েই এরা ভাগ্য গড়েছিলেন। তখন এদেশের সুযোগ সুবিধা যা ছিল তার সবটুকু হাতিয়ে নেওয়ার পর আবার আদী খাসলতে ফিরে গিয়েছিলেন। বাবুদের মনোরঞ্জনের জন্য ইসলামী মূল্যবোধ এবং মুসলমানদের ইতিহাস ঐতিহ্যে আঘাত হানতে থাকেন। ডিগবাজি বিশারদ এই বুদ্ধি ব্যাপারীদের আমরা ছাড়িনি। ওদের স্বরুপ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ‘আজ’ সব সময় লড়াকু ভূমিকা পালন করেছে ।
মুহিউদ্দিন খান সাহেব বিশেষ একজন মানুষ ছিলেন, একাধারে বিদগ্ধ আলেম, সাংবাদিক, লেখক হিসেবে তিনি সুপরিচিত, তিনি ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছিলেন, ২য় বিশ্ব যুদ্ধের ডামাডোল আর এদেশে ইংরেজ সৃষ্ট মুসলমানদের দূর্ভিক্ষ, ও হিন্দু জমিদারদের নীতিবঞ্চিত বৈরী পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন। ঢাকা আলিয়ায় বিভিন্ন বড় বড় আলেমের নিকট পড়েছেন। এবং পরবর্তীতে নিজেও আলেম হিসেবে গণমান্য হয়েছেন। বাংলায় মা’আরেফুল কোরআনের অনুবাদ সহ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থের প্রণেতা তাঁর জীবনের নানা ঘটনা তুলে ধরেছেন বইটিতে । দেশভাগের আগ-পর, মুসলমানদের উপর জমিদারদের অত্যাচার, ৪০ দশকের কঠিন দূর্ভিক্ষ, ইংরেজদের বিভিন্ন ফেতনায় বাংলার আলেমদের মোকাবিলা সবই প্রত্যক্ষ বর্ণনা দিয়েছেন। বিশেষ করে কাদিয়ানী ফিতনার মোকাবিলায় মুন্সি মেহেরুল্লার অবস্থান আলোচ্য, লিখেছেন সৈয়দ আহমদ শহীদ সহ বহু আলেমদের সমাজ সংস্কারমূলক বিভিন্ন কাজের কথা। যাদের আলোচনা আজ পুরোপুরিই বিলীন। শামসুল উলামা বেলায়েত হোসেন, মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমী, মাওলানা আকরাম খাঁ, মুফতি সৈয়দ আমিমুল ইহসান বাংলার এসব বড় বড় আলেমদের তিনি সান্নিধ্য লাভ করেছেন।
আশ্চর্যের বিষয় কত বই পড়লাম, কত আলেম উলামার মজলিসে বয়ান শুনলাম অথচ নিজ ভূমির আলেমদের কথাই কোথাও শুনলাম না! যাদের জ্ঞান গরিমার মাহাত্ন্য এবং নানা ক্রিয়াকর্ম নিয়ে এক একটা গ্রন্থ রচিত হতে পারত! তাদের কথা মাদ্রাসা পাঠ্য কোন বই পুস্তকেও পাওয়া যায় না। অতীশ দীপঙ্করের কথা, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যা সাগরের কথা, কেরী সাহেবের মুন্সি রাম রাম বসুর কথা, রাজা রামমোহন রায়ের কথা এদেশের সামান্য লেখাপড়া জানা ব্যাক্তিও জানে কিন্তু ইমামুদ্দীন বাঙ্গালী, ছুফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী, মুন্সি মেহেরুল্লাহ, চট্রগ্রামের মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ বাঙ্গালী, মাওলানা আব্দুল হামিদ, টাঙ্গাইলের হাফেজ মুহাম্মদ আলী খান পন্নী, মৌলভী নঈমুদ্দিন, রাজশাহীর মির্জা ইউসুফ আলী প্রমুখ অগণিত জ্ঞানী গুনি ও সমাজ সংস্কারকের নাম আমরা কয়জনে জানি!
এ দেশে ইসলাম সঠিক ভাবে না পৌঁছার আরেকটা কারণ মনে করি, দেশের আলেম উলামাদের কলম হাতে নেওয়ার অপরাগতা। খান সাহেব এটা নিয়েও কিছু লিখেছেন।
খৃষ্ঠানরা বেশিরভাগ ক্রুসেড যুদ্ধগুলোতে মুসলমানদের সাথে পরাজিত হয়েছিল। শেষমেশ ভারত বর্ষে ইংরেজদের আগমন ক্রুসেডের প্রতিশোধ নেওয়ারও একটা কারণ ছিল। ইংরেজরা মুসলমান আলেমদের বিশেষ ভয় করত! সিপাহী বিপ্লবের পুরো প্রতিশোধটা ইংরেজরা আলেমদের উপরই নিয়েছিল। এদিক থেকে আলেমরা অনেকটাই হিম্মত হারিয়ে ফেলেছেন।
আবার এই তো কিছুদিন আগে কামাল পাশা আতাতুর্ক যখন উসমানী খেলাফতের কবর রচনা করল তখন বিশ্বের নানা জায়গায় মুসলমানরা প্রতিবাদ করেছিল।
১০৩ পৃষ্টায় খান সাহেব লিখেছেন ইহুদী ও খৃষ্টান দুনিয়ার উস্কানিতে ঐতিহ্যবাহী ইসলামি খেলাফত উচ্ছেদ প্রতিরোধ আন্দোলনে সমগ্র উপমহাদেশের লক্ষাধিক আলেম ও ইসলামি নেতা-কর্মী স্বেচ্ছায় গ্রেফতার বরণ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে বাংলার আলেম উলামা ছিলেন প্রায় চব্বিশ হাজার।
এদিক থেকেও আলেম উলামারা তখন অনেকটাই পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
এ দেশে ইসলাম এসেছেই ওলী আওলিয়াদের মাধ্যমে। সুতরাং কলম ধরার প্রয়োজনটা অনুভূত হয়নি। যুগের বড় বড় আলেমদের মধ্যে যারা চলে গেছেন বা আছেন তাদের মধ্যে এক খান সাহেব ছাড়া আর কাউকে লেখালেখিতে তেমন দেখা যায়নি। আলহামদুলিল্লাহ আলেমদের মধ্য থেকে না হলেও অনেকেই এখন নাস্তিকদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। যদিও ইসলামের সুরক্ষা করা প্রতিটি মুসলিমেরই কর্তব্য কিন্তু আলেমদের একটা দল অন্তত এদিকে প্রয়োজন ছিল।
জীবনের খেলাঘরে বইটি না পড়তে পারলে অজ্ঞতার খতিয়ান এক মহাসমুদ্রের ন্যায় থাকত। আলহামদুলিল্লাহ বইটি পড়তে পেরে যেন অনুভূত হল জ্ঞানের এক মহাসমুদ্র পাড়ি দিলাম।
[রিভিউ লেখক : হাসান ইমরান ]বি:দ্র: জীবনের খেলাঘরে বইটি free pdf download করিতে চাহিয়া লেখকদের নিরুৎসাহিত করিবেন না
Reviews
There are no reviews yet.