এরদোয়ান দ্যা চেঞ্জ মেকার
১৯৯৯ সালের ১৭ এপ্রিলের সংসদ নির্বাচনে ড. নাজিমুদ্দিন আরবাকানের ইসলামপন্থি দল রেফা পার্টির হয়ে ‘মেরভে কাভাকচি’ নামের এক ভদ্র মহিলা ইস্তান্বুল প্রদেশ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
২ মে সংসদ অধিবেশন শুরু হলে শপথ নিতে তিনি সংসদে প্রবেশ করেন। কিন্তু ঢুকতেই বিপত্তি! অন্যান্য দলগুলো থেকে চরম আপত্তি ওঠে। অসম্মানজনক আচরণ করে তাকে বের করে দেওয়া হয়। তার একটাই অপরাধ ছিল, তিনি স্কার্ফ পরে সংসদে ঢুকেছেন।
প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ডেমোক্রেটিক লেফট পার্টির বুলেন্ট এজেবিত, যিনি দাঁড়িয়ে স্পিকারকে বলেছিলেন, এই স্কার্ফ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নিয়মের সাথে সাংঘর্ষিক। তাকে এখনই বের করে দেওয়া হউক। পরে তাকে শুধু অপমান করে বের করেই দেওয়া হয়নি, বরং তার নাগরিকত্বও বাতিল করা হয়।
স্কার্ফের কারণে এই ভদ্র মহিলার নির্যাতনের ইতিহাসটা এখানেই শুরু নয়। তার জীবনীটি যদি তুলে ধরি, তাহলে আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে।
১৯৬৮ সালে আনকারায় তাঁর জন্ম। পিতা ইসলামি আইন বিষয়ের অধ্যাপক আর মা জার্মান ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। তুরস্কের এরজুরুম প্রদেশ থেকে স্কুল জীবন সমাপ্ত করে আনকারায় কলেজ জীবন সফলতার সাথে সমাপ্ত করেন। আনকারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল ফ্যাকাল্টিতে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু দুবছরের মাথায় স্কার্ফ পরার অজুহাতে তার ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়।
পরবর্তীতে আমেরিকার টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় খেকে কম্পিউটার সাইন্সে গ্রাজুয়েশন সমাপ্ত করেন। এর মাঝে স্কার্ফ পড়ার অধিকার আদায়ের জন্য সত্তর ও আশির দশকে কর্মজীবি মহিলারা আন্দোলন করেছিল। যাতে তার মাও অংশ নেন। ১৯৭৪ সালে তার মাকে আতাতুর্ক ইউনিভাসিটি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
১৯৯৯ সালে যখন তার এমপি পদ বাতিল ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়, তখন তিনি চলে যান আমেরিকায় এবং সেখানে গিয়ে হার্ভার্ট বিশ্বদ্যিালয় থেকে লোকপ্রশাসন বিভাগে মাস্টার্স ও হওয়ার্ড ইউনির্ভাসিটি থেকে রাজনীতি নিয়ে পিএইচডি সমাপ্ত করেন। পিএইচডি শেষ করে জর্জ ওয়াশিংটন ইউনির্ভাসিটি ও হওয়ার্ড ইউনির্ভাসিটিতে শিক্ষকতা শুরু করেন।
পেশাগত জীবনে তার সফলতার জন্য জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তৈরি করা প্রতিবেদনে ‘বিশ্বের প্রভাবশালী ৫০০ মুসলিম ইন্টালেকচুয়ালের’ স্থান করে নেন। তার বেশ কয়েকটি বই ও একাডেমিক আর্টিক্যালও রয়েছে । এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ন হল, ‘স্কার্ফবিহীন গণতন্ত্র: ইতিহাসের ভিতর ইতিহাস (তুর্কি ভাষায় লেখা)।
স্কার্ফ নিয়ে এ ধরণের নির্যাতনের শিকার সংখ্যা প্রায় হাজারো। যারা পেশাগত জীবনে অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন কিন্তু শুধু হিজাব পরার কারণে তাদের কর্মস্থল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আর তাই হিজাব ছিল তুরস্কের নারীদের একটি অধিকার এবং মর্যাদার বিষয়।
এরদোয়ানের নেতৃত্বে একে পার্টি ক্ষমতায় এসে নারীদের দীর্ঘদিনের বঞ্চিত করা অধিকার হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে আইন পাশ করেন। তবে এখানে গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। আর তা হল, এই হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার তিনি তিনি রাতারাতি করতে পারেন নি। পুরোপুরি হিজাবের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে সময় নিয়েছেন ১২ বছর।
প্রথমে ক্ষমতায় আসার পর হিজাবের পক্ষে সংসদের ভেতরে ও বাহিরে কথা বলেছেন, পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। ‘আমরা হিজাব পরিহিত কিংবা হিজাববিহীন সকলকে একই আইনের অধিকারের আওতায় আনতে চাই’। দল সমর্থিত বুদ্ধিজীবিরা এর পক্ষে কলম ধরেছেন, মিডিয়া এর পক্ষে কথা বলেছে। একে পার্টির নেতা-কর্মীরা এরপক্ষে সাধারণ জনমত সৃষ্টি করেছেন।
২০০৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট, আব্দুল্লাহ গুলের স্ত্রীর হিজাব পড়া নিয়ে সামরিক বাহিনী ও সাংবিধানিক আদালতের বিরুদ্ধে জনমতের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। অন্যান্য দলগুলোকে এর পক্ষে কথা বলতে প্রভাবিত করেছেন। এরপর ২০১০ সালে প্রথম ইউনির্ভাসিটিতে হিজাব পরার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
২০১৩ সালে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। এরপর সর্বশেষ পর্যায়ে ২০১৪ সালে স্কুলগুলোতে হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মাধ্যমে সকল পর্যায়ে হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়।
২০১৩ সালের ৩১ অক্টোরব প্রথমবারের মতো একে পার্টির চার এমপি সংসদে হিজাব পরে প্রবেশ করেন। কিন্তু এবার কেউ আর প্রতিবাদ করতে পারেন নি। ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর সর্বপ্রথম হিজাব পরিহিতা এমপিরা শপথ নেন (আগের চারজন শপথ নেওয়ার সময় হিজাব খুলে শপথ নিতে হয়েছিল)।
এরদোয়ান এখানেই থেমে থাকেননি। একে পার্টি ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে মেরভে কাভাকচির (যাকে সংসদে শপথ পড়তে দেয়া হয়নি এবং উল্টো নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছিল) ছোট বোন ড. রাভযা কাভাকচিকে ইস্তান্বুলের এমপি হিসেবে মনোনায়ন দেন এবং তিনি নির্বাচিত হন। ২০১৫ সালের জুনে হিজাব নিয়ে সংসদে এমপি হিসেবে শপথগ্রহণ করেন।
ড. রাভযা কাভাকচিও তার বড় বোনের মতোই উচ্চশিক্ষিতা এক ভদ্র মহিলা, যিনি এখন ইস্তান্বুলের এমপি এবং একে পার্টির মানবাধিকার বিষয়ক ডিপুটি চেয়ারম্যানের (দলের ১৬ জনের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তগ্রহণকারী ফোরামের একজন) দায়িত্ব পালন করছেন। আর মেরভে কাভাকচিকে শুধু নাগরিকত্বই ফিরিয়ে দেননি, তার যোগ্যতা বলে নানা জায়গায় দায়িত্ব পালন করার পর ২০১৭ সালের জুন মাসে তাকে মালয়েশিয়ায় তুরস্কের রাষ্টদূত হিসেবে মনোনীত করা হয়। তিনি এখন মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বি:দ্র: এরদোয়ান দ্যা চেঞ্জ মেকার বইটি free pdf download করিতে চাহিয়া লেখকদের নিরুৎসাহিত করিবেন না
Reviews
There are no reviews yet.