ইসলামী জাগরণের রূপরেখা
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। ইসলামের শুরু থেকেই ইসলামী বিধি-বিধান সম্পর্কিত শিক্ষা প্রজন্মের পরম্পরায় প্রসার হয়ে আসছে। সময়ের আবর্তে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মাঝে। পরিবর্তন ঘটে মানুষের ভাব ও ভাষায়। তাই সব যুগেই আলিমগণ মানুষের চাহিদা মোতাবেক ইসলামের বিধি-বিধান সম্বলিত বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. সমকালীন মুসলিমদের চাহিদা বিবেচনায় রেখে আলোচ্য গ্রন্থটি রচনা করেন।
গ্রন্থটি লেখকের রচিত মূল আরবী গ্রন্থ “دستور الحياة” এর বাংলা অনুবাদ। গ্রন্থটি আট অংশে সন্নিবেশিত।
• লেখকের ভূমিকা
• ইসলামের মৌলিক গঠন ও অনন্য বৈশিষ্ট্য
• আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকীদা ও বিশ্বাস
• ইবাদাত
• আল্লাহর পথে জিহাদ
• আত্মশুদ্ধি ও চরিত্র গঠন
• ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি
• কিছু অভিজ্ঞতা, কিছু পরামর্শ
ভূমিকা অংশে লেখক এ সম্পর্কিত অন্যান্য গ্রন্থের পরিচয়, উদ্দেশ্য ও সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন। এতগুলো গ্রন্থ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও নতুন করে এই গ্রন্থ রচনার কারণ ব্যাখ্যা করেন।
“ইসলামের মৌলিক গঠন ও অনন্য বৈশিষ্ট্য” আলোচনায় লেখক ঈমান, আকীদা, দাওয়াত, তাবলীগ নিয়ে আলোচনা করেন। তাবলীগের কাজ আঞ্জাম দিতে গিয়ে নবীগণের মর্যাদাবোধ ও পরকালীন জীবনকে প্রাধান্য দেয়ার বিষয় উল্লেখ করেন। এছাড়াও আল্লাহই যে একমাত্র বিধানদাতা, জীবনবিধান হিসেবে ইসলামের পরিপূর্ণতা, কুরআনের অবিনশ্বরতা ও দ্বীনের অনুকূল পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করেন।
“আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকীদা ও বিশ্বাস” অংশে লেখক প্রথমে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস সমূহ নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর তাওহীদ, দ্বীন ও শিরকের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন শিরকমূলক কাজ, জাহেলী প্রথা ও কুসংস্কার, নবী প্রেরণের প্রধান উদ্দেশ্য ও প্রকাশ্য শিরক নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর বিদআতের পরিচয় উল্লেখ করে বিদআতের বিরুদ্ধে আলেমদের সংগ্রাম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন।
“ইবাদাত” অংশের শুরুতে ইবাদতের মর্যাদাগত স্থান নিয়ে আলোচনা করে ক্রমান্নয়ে রাসূল ﷺ এর নামায, রোজা, যাকাত ও সদকা, হজ্ব ও ওমরা পালনের পদ্ধতি এবং দোয়া ও যিকির নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. লিখিত “আল ওয়াবিলুস সাইয়িব” গ্রন্থ থেকে রাসূল ﷺ এর কিছু ব্যাপক অর্থবহ দোয়ার উল্লেখ করা হয়।
“আল্লাহর পথে জিহাদ” অংশে জিহাদ নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু পরিপূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে। ইসলামে জিহাদের মর্যাদা, প্রকারভেদ ও ক্রম বিন্যাস, ফযীলত, আদব ও উপকারিতা উক্ত আলোচনায় উঠে আসে।
“আত্মশুদ্ধি ও চরিত্র গঠন” অংশের আলোচনাকে ছোটখাট সীরাত বলা যায়। এখানে রাসূল ﷺ ও সাহাবাগণের বিভিন্ন অনন্য গুণাবলী, চরিত্র মাধুর্য ও স্বভাব প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। শেষে এমন কিছু আয়াত ও হাদীসের উল্লেখ করা হয়, যা একজন মুমিনের আত্মশুদ্ধি ও চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
“ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি” অংশে লেখক ইসলামী ও পশ্চিমা সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরে এই দুই সভ্যতার তুলনামূলক আলোচনা করেন। পশ্চিমা সভ্যতার অসারতা ও ক্ষতিকর দিকসমূহ উল্লেখ করে সেসব থেকে মুসলিমদের সতর্ক করেন।
“কিছু অভিজ্ঞতা, কিছু পরামর্শ” মূলত অনুবাদকের সংযোজিত। মূল গ্রন্থের উপসংহার হিসেবেই তিনি উক্ত আলোচনা করেন। এখানে তিনি গ্রন্থটি অধ্যয়নের কিছু দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করে যুগের আলোকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা প্রদান করেন।
বিষয়বস্তু বিবেচনায় গ্রন্থটিকে একজন মুসলিমের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ গাইডবুক বলা যায়। গ্রন্থটির বিষয়বস্তু নতুন কিছু না হলেও লেখক যুগের চাহিদার আলোকে যুগের ভাষায় সংক্ষিপ্ত কলেবরে গ্রন্থটি রচনা করেন। তাই একজন পাঠক সহজেই গ্রন্থটির বিষয়বস্তু বুঝতে পারবেন। মাওলানা আব্দুল মালেক হাফিযাহুল্লাহ্ সাধারণ মানুষদের যেসকল গ্রন্থাবলী অধ্যয়নের পরামর্শ দিয়েছেন, এই গ্রন্থটি তার অন্তর্ভুক্ত।
যারা ঈমাম গাযালি রহ.’র “ইহয়াউ উলুমিদ্দিন” এবং ইবনুল কায়্যুম রহ.’র “যাদুল মা’আদ” পড়েছেন, তাদের কাছে গ্রন্থটিকে অতি সাধারণ মনে হতে পারে। তারপরও এমন অনেক পাঠক আছেন যারা সংক্ষিপ্ত কলেবরের এই গ্রন্থ থেকে উপকৃত হতে পারবেন।
যারা লেখকের “মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারাল?” ও “মুসলিম বিশ্বে ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব” গ্রন্থ দু’টি পড়েছেন, স্বাভাবিকভাবেই তারা এমন এক গ্রন্থের মুখাপেক্ষী ছিলেন যা তাদের জীবন চলার গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিবে। এই গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে সেই চাহিদা মেটাবে। এছাড়াও ব্যস্ততার এই যুগে বিস্তারিত অধ্যয়নের জন্য সময় বের করা যাদের জন্য কষ্টকর, তারাও এই গ্রন্থ থেকে উপকৃত হতে পারবে।
পরিশেষে বলা যায়, নফসের খায়েশ থেকে মুক্ত হয়ে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাওহীদি জিন্দেগী যাপনের জন্য গ্রন্থটি সহায়ক হবে। কারণ আলী মিঞা রহ.’র রচনা মানেই একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, যা কোন কিছুর অসারতা ও আবর্জনা দূর করে মূল নির্যাস ও সঞ্জীবনী বের করে আনে।
লেখেছেনঃ Riaz Ud-daula
বি:দ্র: ইসলামী জাগরণের রূপরেখা বইটি free pdf download করিতে চাহিয়া লেখকদের নিরুৎসাহিত করিবেন না
Riaz Ud-daula –
বিংশ শতকের শুরুর দিকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রতীক খিলাফত বিলুপ্ত করা হয়। পাশ্চাত্যের মদদে মুসলিম দেশগুলোতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থান ঘটে। উপেক্ষিত হতে থাকে ইসলামী তাহজীব তমদ্দুন। এর মধ্য থেকেও আল্লাহর কিছু পরীক্ষিত বান্দার হাত ধরে বিভিন্ন ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের উত্থান হতে থাকে। আলেম সমাজের মাঝ থেকেও অনেক বিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান আলিম তাঁদের বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে উম্মাহকে জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টা চালান।
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী যিনি প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বিভিন্ন ধর্মীয়, দাওয়াতী ও সংস্কারমূলক আন্দোলন খুব কাছ থেকে দেখেছেন, যাচাই করেছেন। নিজের এসব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বিভিন্ন বক্তৃতা বিবরণীতে ইসলামী জাগরণের বিভিন্ন রূপরেখা তুলে ধরেন ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা প্রদান করেন।
আলোচ্য গ্রন্থটি লেখকের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা ও প্রবন্ধের সংকলন যেগুলো বিভিন্ন সময়ে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ হয়। পুস্তিকাগুলো হল –
• ইসলামী জাগরণের রূপরেখা
• পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসন
• বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুসলমানদের করণীয়
• আরববিশ্ব পশ্চিমাবিশ্বের টার্গেট কেন?
• আরবজাতীয়তাবাদ আরববিশ্বের জন্য মারাত্মক শংকা
প্রথম পুস্তিকাটি ১৯৮৮ সালের ২৯শে নভেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের সংস্কৃতি কেন্দ্রের হলরুমে প্রদত্ত বক্তৃতা। বক্তৃতায় তিনি মুসলিম ও অমুসলিম রাষ্ট্রে ইসলামী জাগরণের রূপরেখার উপর আলোকপাত করেন। মুসলিম ও অমুসলিম উভয় ধরনের রাষ্ট্রেই ইসলামী জাগরণের জন্য পাঁচটি করে রূপরেখা পেশ করেন।
দ্বিতীয় পুস্তিকাটি ১৪১৭ হিজরীর যিলহজ্ব মাসে “দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা”র দাওয়াত ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পৃষ্টপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত “ইসলামী দাওয়াত ও গবেষণা অনুষদ”র নতুন শিক্ষাবর্ষের উদ্বোধনী বক্তৃতা। উক্ত বক্তৃতায় তিনি ছাত্রদের মাঝে উক্ত প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কার্যকারীতা, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। অতীতের ক্রুসেডার ও তাতারী ভয়াবহতার উদাহরণ টেনে তিনি আলেমসমাজের সচেতন হওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেন। বক্তৃতার দ্বিতীয় অংশে তিনি প্রাচ্যবিদদের সম্পর্কে অবহিত করে তাদের ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেন। শেষ অংশে তিনি আরব বিশ্বে ইসলামী জাগরণের উপর গুরুত্বারোপ করে এই উদ্দেশ্যে নদওয়ার ছাত্রদের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
তৃতীয় পুস্তিকাটি লেখকের একটি প্রবন্ধ যা তিনি ১৯৯০ সালের ৩০শে অক্টোবর গুজরাটের ভয়াবহ দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে রচনা করেন। গুজরাটের হাঙ্গামার কারণে মুসলমানদের মানসে যে হতাশা ও ভয়ের কালোমেঘ জমেছিল, সেটা থেকে উত্তরণের জন্য ছয়টি উপদেশনামা পেশ করেন।
চতুর্থ পুস্তিকায় লেখক আরব বিশ্বের গুরুত্ব ও তার দরুন আরব বিশ্ব পশ্চিমাদের টার্গেটে পরিণত হওয়ার বিষয়টি আলোচনা করেন। এ আলোচনায় তিনি ইসলামের প্রসারে আরব ভূখণ্ডের সোনালী অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদেরকে আবারো ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে আসীন হওয়ার আহ্বান জানান। এ উদ্দেশ্যে তিনি বেশ কিছু দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন।
পঞ্চম পুস্তিকাটিও একটি প্রবন্ধ যাতে লেখক আরবজাতীয়তাবাদ ও তার কুফল নিয়ে আলোচনা করেন। এখানে তিনি আরব জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেন যে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য আল্লাহ তাদের বাছাই করেছেন, অথচ তারাই আজ ইসলাম থেকে গাফেল হয়ে জাতীয়তাবাদের চেতনায় মত্ত। তাদের এই অধঃপতনের নেপথ্য কারণ হিসেবে লেখক পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্রকে চিহ্নিত করেন।
গ্রন্থটি লেখকের কতগুলো বক্তৃতা ও প্রবন্ধের সংকলন হলেও এগুলোর উপজীব্য ছড়িয়ে আছে লেখকের অন্যান্য মৌলিক গ্রন্থে। সময় ও ঘটনার প্রয়োজনে তথ্যগুলোকে লেখক সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করেছেন। লেখক বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলো প্রয়োজনীয় টিকা যুক্ত করেছেন। অনুবাদক নিজেও কিছু টিকা সংযুক্ত করে গ্রন্থটিকে আরো সহজবোধ্য করেছেন। তবে অনুবাদকের সংযোজিত ১০৯ নাম্বার টিকায় উসমানী খিলাফত সম্পর্কিত ভুল ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে যা সংশোধনের দাবী রাখে। এছাড়া অনুবাদের প্রাঞ্জলতা, প্রচ্ছদ, বাঁধাই, ছাপার মান বিবেচনায় গ্রন্থটি যথেষ্ট গুণগত মানসম্পন্ন।
আলী মিঞা নদভী রহ.’র লেখাগুলোতে এমন দৃষ্টিভঙ্গি উঠে আসে যা পাঠকের চিন্তার জগতে আলোড়ন তোলে। সকল জড়তা, নিরাশা দূর করে ঈমানকে জাগিয়ে তোলে। উক্ত গ্রন্থটিও এর ব্যতিক্রম নয়। গ্রন্থটি থেকে সাধারণ মানুষ যেমন উপকৃত হতে পারবেন, তেমনি তালেবে-ইলম, রাজনীতিবিদ ও সমাজ সংস্কারকদের জন্যও এতে রয়েছে অনেক দিক-নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা।
বর্তমান যুবসমাজের জন্য এধরনের একটি গ্রন্থের প্রয়োজন অত্যধিক। কারণ যুবসমাজই পারে আত্মমর্যাদা হারা ও ধুঁকে ধুঁকে চলা মুসলিম জাতিকে দুর্দশা থেকে টেনে তুলে এক সোনালী ভোরের দিকে এগিয়ে নিতে। যে দ্বীনের দাবীই হল দুনিয়া শাসন, সে দ্বীনের অনুসারীরা কিভাবে নিষ্প্রভ থাকতে পারে? প্রয়োজন এক ইসলামী পুনর্জাগরণের। এই গ্রন্থটি সেই কাঙ্ক্ষিত জাগরণেরই এক রূপরেখা।