ইলমের ভালোবাসায় চিরকুমার উলামায়ে কেরাম
সামর্থ্য থাকলে রাসূল (সা) যুবকদেরকে বিয়ে করতে বলেছেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি বিয়ের ফযীলত বর্ণনা করেছেন। উত্তম স্ত্রীর বরকতের কথা বলেছেন। অনেক নবী-রাসূল (আ) একাধিক বিয়ে করেছেন। রাসূল (সা) বিয়ে করাকে তাঁর ‘সুন্নাত’ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। আমাদের সম্মানিত সাহাবারাও (রা) একাধিক বিয়ে করেছেন।
তবে সবার তো আর আর্থিক সঙ্গতি থাকে না। সেক্ষেত্রে, রাসূল (সা) সিয়াম পালনের পরামর্শ দিয়েছেন। আবার কখনো কখনো পরিস্থিতি অনুকূলে থাকে না। কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিয়ে করলে দুনিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। ব্যস্ততার কারণে ইলম ও আমল থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। এগুলো বিয়ের অপকারী দিক। অনেক ভাই-ই নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন, বিয়ের আগে তারা দাওয়াহ ও ইলমের জন্য যেমন সময় দিতে পারতেন, এখন আর সেভাবে পারছেন না। আবার বিয়ের উপকারী অনেক দিকও রয়েছে। স্ত্রীরা আমাদের ফিতনা থেকে দূরে রাখে, চাহিদা পূর্ণ করে, অন্তরে শান্তি এনে দেয়। বিয়ে না করলে অনেকের মারাত্নক গোনাহে লিপ্ত হবার আশঙ্কা দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে, করণীয় কী?
সালাফরা সুন্দর পরামর্শ দিয়ে গেছেন। তারা বলেছেন, এটা আসলে ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর করে। কারো জন্য বিয়ে করা উত্তম। আবার কারো জন্য অবিবাহিত থাকাই উত্তম। বিয়ের আগে উচিত নিজেকে অনেস্টলি প্রশ্ন করা। আচ্ছা! বিয়ে কি আমাকে দ্বীন থেকে দূরে সরিয়ে নিবে নাকি বিয়ে না করলে আমার দ্বারা আরো বেশি গোনাহ হয়ে যাবে? তার উচিত, বিয়ের উপকারিতা আর অপকারিতা দুই পাল্লায় রেখে পরিমাপ করা। যেদিকে পাল্লা ভারী হবে সেদিকে যাওয়া।
সালাফদের অনেকেই বিয়ে করেননি। কিন্তু এটা তাদের একান্ত জীবনদর্শন ছিল। তারা কাউকে অবিবাহিত থাকতে বলেননি। মজার ব্যাপার তারা নিজেরাই বিয়ের অনেক ফযীলত বর্ণনা করেছেন। একই সাথে, বিয়ে করলে কী কী ফিতনা হতে পারে তাও জানিয়েছেন।
বিয়ে যে ইলম সাধনা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়, সে ব্যাপারে সাবধান করে উমার (রা) বলেছিলেন, “বিয়ে আর নেতৃত্ব গ্রহণের পূর্বে তোমরা জ্ঞানার্জন করো।” ইমাম আবু হানিফা (রহ) তার ছাত্রের জন্য রচিত ওসীয়তনামায় লিখেন,
“ইলম অর্জনের আগে নারীর সোহাগ থেকে দূরে থাকো। এতে তোমার সময় নষ্ট হবে। পুত্র-কন্যা হবে। তুমি তাদের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টায় লিপ্ত হবে। আর এভাবে ইলম থেকে দূরে থেকে যাবে।”
সুফিয়ান আস সাওরী (রহ) উপমা দিয়ে সুন্দর করে বুঝিয়েছেন, “বিয়ে করা মানে নৌকায় চড়া। আর সন্তান হওয়া অর্থ নৌকার তলা ফেটে যাওয়া। যা পানিতে তলিয়ে যাবে যে কোন মূহুর্তে।” এ জন্য চূড়ান্ত ফিতনায় পড়ে যাবার আশঙ্কা না থাকলে সালাফরা ছাত্রদের বিয়ে করতে নিষেধ করেন। খতিব বাগদাদি (রহ) বলেন, “ছাত্রদের জন্য যথাসম্ভব বিয়ে না করা মুস্তাহাব।” ইবনুল জাওযী (রহ) এর কারণ ব্যাখ্যা করে লিখেন,
“প্রাথমিক পর্যায়ের ছাত্রদের জন্য আমি যথাসম্ভব বিয়ে না করাকে প্রাধান্য দেই। কেননা, ইমাম আহমেদ ইবনে হাম্বল (রহ) চল্লিশ বছর বয়সে এসে বিয়ে করেন। আর এটা তিনি করেন, ইলম অর্জনের জন্য।”
অনেক সালাফদের কাছে বিবাহিত জীবন মানেই ছিল বন্দী জীবন। শায়খ মা’মর ইবনে রাশেদ (রহ) ছিলেন শ্রেষ্ঠ হাদীস বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অন্যতম। একবার ইয়ামানে তিনি হাদীস শিক্ষা দিতে গিয়েছিলেন। শায়খের জ্ঞান দেখে ইয়ামেনের মানুষ তাকে পছন্দ করে ফেললো। তারা তাকে আটকে ফেলার ব্যবস্থা করে ফেললো। কীভাবে? সেখানকার লোকেরা তাকে ইয়ামানের সম্ভ্রান্ত এক মেয়ের সাথে বিয়ে করিয়ে দিলো। বেচারা শায়খ আজীবনের জন্য ইয়ামানে আটকে গেলেন। বন্দী হলেন স্ত্রীর মায়াবী বন্ধনে। ‘বিয়ে মানেই বন্দীত্ব’ এ অবস্থার কথা ইঙ্গিত করে এক কবি মজা করে বলেন,
“তারা বন্দী করলো এক নেকড়েকে,
কী শাস্তি দেয়া যেতে পারে এটাকে?
বুড়ো এক ব্যক্তি বলল, তাকে বিয়ে করিয়ে দাও,
আর তার শাস্তিতে তাকে ছেড়ে দাও।”
ঈসা (আ) সম্পর্কে একটি ঘটনা আহমেদ ইবনে হাম্বল (রহ) তার ‘কিতাবুয যুহদ’- এ এনেছেন। তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “আপনি বিয়ে করেননি কেন?”
ঈসা (আ) জবাব দিলেন, “মরণশীল স্ত্রী দিয়ে আমি কী করবো?”
সালাফরা শুধু বড়ো বড়ো কথার মাঝেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বাস্তব জীবনেও অবিবাহিত থেকে ইলমের প্রতি তাদের ভালোবাসার প্রমাণ দেখিয়েছেন। জারির আত তাবারী (রহ) হচ্ছেন সবচেয়ে সেরা কুরআনের তাফসীরের রচয়িতা। সে তাফসীরের সমতুল্য তাফসীর আজো লেখা সম্ভব হয়নি। তিনি ত্রিশ হাজার পৃষ্ঠার একটি তাফসীর লেখার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। ছাত্ররা ভয় পেয়ে যাওয়াতে তিন হাজার পৃষ্ঠার তাফসীর লিখেন। ইবনে কাসির (রহ) সে তাফসীর থেকে দূর্বল দলীল বাদ দিয়ে আরো ছোট করে একটি তাফসীর লিখেন। যা এখন ‘তাফসীর ইবনে কাসির’ নামে পরিচিত। আমরা তো ‘তাফসীর ইবনে কাসির’ পড়েই শেষ করতে পারি না। জারির আত তাবারী (রহ) চিরকুমার ছিলেন। তিনি গর্ব করে বলতেন, “জীবনে কোন নারীর জন্য আমি আমার সেলোয়ার খুলিনি। না হালাল, না হারাম।”
ইমাম নববী (রহ) হচ্ছেন ‘রিয়াদুস স্বলেহীন’, ‘আল আরবাঈন’, ‘শরহু সহীহ মুসলিম’ সহ আরো অসংখ্য অসাধারণ গ্রন্থের লেখক। ইলম অর্জনের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি জীবনের এক মুহুর্ত সময়ও নষ্ট করেননি। একবার তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “বিয়ে করেননি কেন?”
উনি জবাব দিলেন, “ভুলে গিয়েছি।”
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ)। শায়খুল ইসলাম। প্রায় ৩৫০ গ্রন্থের রচয়িতা। তাকে ছাড়া যথাযথ ইলম অর্জন অসম্ভব। শুধু ইলম অর্জন না জিহাদের ময়দানেও ছিলেন একইভাবে পারদর্শী। কলম আর তরবারী দুইটিই তার সমান তালে চলেছে। তাতারীদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের একত্রিত করেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে মাথা পেতে নিয়েছেন কারাগারকে। শায়খ অবিবাহিত ছিলেন।
আরো অনেক সালাফদের কথা আনা যায়। আবু বকর আল আম্বারী (রহ) সনদসহ ১২০টি তাফসীর মুখস্থ বলতে পারতেন। কুরআন কারীমের অর্থ ও মর্ম জানার জন্য তিন লক্ষ কবিতার পঙক্তি মুখস্থ করেছিলেন। তিনিও অবিবাহিত ছিলেন। একবার এক দাসীকে ঘরে এনেছিলেন। কিন্তু দেখলেন দাসীর কারণে অন্তর ইলম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সাথে সাথে সে দাসীকে বিদায় করে দেন।
আরো বলা যায়, আবু নাসর আস সিজঝির (রহ) কথা। তার লেখা “আল ইবানাতুল কুবরা” একটি বিশাল বই। এ বইয়ে তিনি কুরআনের অর্থ ও মহিমার কথা এনেছেন। জ্ঞানীদের কাছে এই বই অতি আশ্চর্যের এক নাম। এক মহিলা একবার তার কাছে একশো দিনার নিয়ে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। বলল, “যদিও আমার বিয়ের তেমন প্রয়োজন নেই, তবুও আপনাকে সেবা করার জন্য বিয়ে করতে চাই।” শায়খ তাকে দীনারসহ ফিরিয়ে দিলেন।
মহিলাটি চলে যাবার পর শায়খ বললেন, “আমি সিজিস্তান থেকে ইলম অর্জনের জন্য বের হয়েছি। কিন্তু বিয়ে করলে তালিবুল ইলমের খাতা থেকে আমার নাম বাদ পড়ে যাবে।”
মানুষ চায় সন্তানদের মাধ্যমে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে। কিন্তু এই উলামাদের কাছে বই ছিলো তাদের সন্তান। ইলমের পাতার রস ছিলো প্রেয়সীর গোলাপী গালের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয়। তাই তারা ইলমকেই বেছে নিয়েছিলেন। আমরা যারা বিয়ে করতে পারছি না, তারা সালাফদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারি। অনলাইনে অনর্থক কান্নাকাটি না করে ইলম অর্জনের চেষ্টায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারি।
আবার অনেকের কাছে, বিয়ে করাই ফিতনা থেকে দূরে থাকার একমাত্র সমাধান। ইলম অর্জন এতো ইম্পোর্ট্যান্ট না। তাদের জন্য সমাধান কী? এতোক্ষণ যে বকবক করলাম তা ইগনোর করুন। এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিন। আর—
“বিয়ে করে ফেলুন।”
[ শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ) এর ‘ইলমের ভালোবাসায় চিরকুমার উলামায়ে কেরাম’- গ্রন্থ থেকে ঘটনাগুলো নেয়া। অনুবাদ করেছেন শায়খ আবু সাঈদ মুহাম্মদ নু’মান। তিনি সেখানে ৩৫ জন উলামার জীবনী নিয়ে এসেছেন যারা ইলমকে ভালোবেসে বিয়ে করেননি।]
বি:দ্র: ইলমের ভালোবাসায় চিরকুমার উলামায়ে কেরাম বইটি free pdf download করিতে চাহিয়া লেখকদের নিরুৎসাহিত করিবেন না
Reviews
There are no reviews yet.