ঈমান ও বস্তুবাদের সংঘাত
ঈমান ও বস্তুবাদের সঙ্ঘাতের ইতিহাস বহু পুরোনো। আল্লাহ রব্বুল আলামীন মানুষ সৃষ্টির পরপরই যখন তাঁর উপর ঈমান আনতে বললেন তখন থেকেই বস্তুবাদ মানুষের পিছে লেগে আছে সেই ঈমান থেকে বিচ্যুতি ঘটানোর পায়ঁতারায়। বলা যায় শয়তানের কাছে আমাদের গাফেল করার জন্য মোক্ষম হাতিয়ার হচ্ছে এই বস্তুবাদ। অন্তরে বস্তুবাদ ঢেলে দাও তো, ঈমানের অর্ধেক বারোটা বেজে যাবেই। আক্বিদা, ঈমান , আমল তখন হয়ে যায় নাম-আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব কিছু আচার আচরণ। হারিয়ে যায় স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস, তাঁর প্রতি ভালবাসা, কৃতজ্ঞতা, আত্নসমর্পণের যথার্থতা ও উদ্দেশ্য।
এই বস্তুবাদ আসলে কি? কিভাবে তার সৃষ্টি? কিভাবেই বা তার কর্তৃত্ব মানব মনের গহীনে?
সহজ কথায় বস্তুবাদ হলো সেই ধ্যানধারণার সমষ্টিগত রুপ যা মানুষের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল করে দেয় যে আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তাই নিয়েই দুনিয়া, তাই নিয়েই জীবন। আমাদের চারপাশের এই আকার উপকরণগুলোর মধ্যেই নির্ধারিত আমাদের কল্যাণ-অকল্যাণ, সুখ-শান্তি। এসবের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এগুলো ব্যবহার করেই দুনিয়া অর্জন তথা সাফল্য অর্জন, সুখ-সমৃদ্ধি লাভ করে মানুষের কাছে নিজেকে জাহির করতে পারা তাদের কাছে নিজেকে সম্মানিত করতে পারা। লক্ষ্য অর্জনে কর্ম ও উপকরণই এখানে মুখ্য যেখানে সর্বশক্তিমান আল্লাহর অনুগ্রহকে অবজ্ঞা এমনকি অস্বিকার করে বসা হয়।
সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী তার এই বইতে সূরা কাহাফের চমৎকার বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখিয়েছেন বস্তুবাদের আসল চেহারা। সাথে দেখিয়েছেন কীভাবে পাশ্চাত্য থেকে বস্তুবাদ আমাদের মুসলিমদের মনে বাসা বেঁধে বসল। পশ্চিমা শক্তি যখন সম্মুখ সমরে বার বার পরাজিত হয়ে বুঝে গেল যে এই জাতিকে অস্ত্র দিয়ে হারানো অসম্ভব তখনই তারা মুসলিমদের ওপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো সহ বস্তুবাদের বীজ তাদের মনে বপন করে দিল। আর মুসলিমরাও কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা ভুলে গিয়ে তাদের ফাঁদে স্বাচ্ছন্দে পা দিয়ে বসল। অধঃপতনের শুরুটাও সেখান থেকেই।
সূরা কাহাফের চারটি ঘটনা যথাঃ আসহাবে কাহাফ যারা মূর্তিপূজক রাজার হাত থেকে ঈমান রক্ষা করতে গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল, দুই বাগানের মালিকের ঘটনা, মুসা আলাইহিস সালাম ও খিযির আলাইহিস সালামের ঘটনা এবং প্রতাপশালী কিন্তু ঈমানদার আল্লাহভীরু রাজা যুলকারনাইন এর ঘটনা। চারটি ঘটনায় রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা।
আসহাবে কাহাফের সাত যুবকের ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয় যে ঈমানের মূল্য সবার আগে। তা রক্ষার্থে সবকিছু ত্যাগ করা মুমিনের জন্যে আবশ্যক। তারা বুঝেছিল যে ঈমানহারা ব্যক্তির জন্য এ দুনিয়া ও আখেরাতে কোনোই নিরাপত্তা নেই। শুধু ঈমানদাররাই বুঝতে পারে এই জীবনের লক্ষ্য কী, আল্লাহর উপর বিশ্বাসের মাধ্যমে যে অন্তরের প্রশান্তি এবং পুরস্কারের আশা তা একমাত্র তারাই করতে পারে। তাই ঈমান বাঁচাতে পরিবার পরিজন ছেড়ে শুধু আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে তারা গুহায় আশ্রয় নেয় যেখানে আল্লাহ তায়ালা তাদের হেফাজত করেন সুদীর্ঘ এক ঘুমে তাদের আচ্ছন্ন করে দিয়ে এবং অঙ্গীকার করেন তাদের পুরস্কৃত করার। কাহিনীটি সবারই জানা। এই ঘটনা থেকে আরও জানা যায় তাওয়াক্কুলের গুরুত্ব এবং এর ফযীলত সম্পর্কে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে যা মনে হয়েছে তা হল এই ঘটনার মাধ্যমে কিয়ামতের সত্যতার প্রমাণ। কাফের নাস্তিক যারা কিয়ামত অস্বীকার করতে চায় তাদের জবাবে আল্লাহ তায়ালা যুবকদের দীর্ঘ তিনশ বছরের ঘুম থেকে জাগিয়ে এবং আবার মৃত্যু বরণ করিয়ে আগেই দেখিয়েছেন যে মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সত্য। জীবন ও মৃত্যুর মালিক একময়াত্র আল্লাহ তায়ালা। কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক।
দুই বাগানের মালিকের ঘটনা আমাদের শেখায় যে দুনিয়ার সব অর্জনই ক্ষণস্থায়ী। সবকিছুর বিনাশ যেকোন সময় ঘটে যেতে পারে। আরও শেখায় মানুষ দুনিয়াবী যতই সাফল্য অর্জন করুক আর ধনসম্পদের মালিক হোক না কেন তার আকাঙ্খার কোনই শেষ নেই। বস্তুবাদী চিন্তার কুফল হচ্ছে এর চাহিদার শেষ বলে কিছু নেই, তাই এ অন্তর সুখ কখনওই পায়না, নিত্য নতুন চাহিদা তার চিন্তাকে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন করে রাখে। এর সমাধানের জন্যেও তারা দুনিয়াবী উপকরণকেই খোঁজে যাতে ব্যর্থ হয়ে মুক্তির পথ তাদের মেলে না, কেননা তাদের মধ্যে নেই আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া এবং তার কাছে চাওয়ার আকুতি। অন্যদিকে যাদের চিন্তা আখেরাতমুখী তারা সবকিছু আল্লাহর উপরে ন্যস্ত করে দিয়েই নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
মুসা(আ) এবং খিযির(আ) এর ঘটনাও সবার জানা যা শিক্ষা দেয় আপাতদৃষ্টিতে যা অকল্যাণকর মনে হয় তার মধ্যে কল্যাণ থাকতে পারে। এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহ তায়ালার গভীর প্রজ্ঞা সম্পর্কে জানতে পারি। তিনি আমাদের যখন বালা মুসিবত দিয়ে পরীক্ষা করেন তখন এর মধ্যে কোথায় যে কল্যাণ লুকিয়ে থাকতে পারে তা জানা আমাদের ধারণার বাইরে। এই বিশ্বাস আমাদের মধ্যে ধৈর্য্যের পরিস্ফুটন ঘটায়।
প্রতাপান্বিত সম্রাট যুলকারনাইনের অভিযান এবং ন্যায়পরায়ণতা আমাদের শেষ যমানার ফেতনার মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। তিনি ছিলেন এমন সম্রাট যাকে আল্লাহ তায়ালা জাগতিক ক্ষমতা দান করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার অপব্যবহার না করে মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন এবং আল্লাহর থেকে প্রাপ্ত নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করেছিলেন। শেষ জমানায় যা হবে তা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। মিথ্যুক দাজ্জাল বহুমূখী ক্ষমতা নিয়ে হাজির হবে এবং নিজেকে প্রভু বলে দাবি করবে। যার ছলনায় ঈমানহারা হবে অগনিত মানুষ। বইটি পড়লে এ সম্পর্কে এমন জ্ঞান অর্জিত হবে যা জানা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য।
সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভীর চমৎকার এক উপহার এই বই যার পাতায় পাতায় এমন কিছু রয়েছে যা চিন্তাশীল মুসলিমের ঈমানের বৃদ্ধি ঘটায়। কুরআন নিয়ে ভাবার নতুন সব দুয়ার খুলে দেয়। সূরা কাহাফের এমন বিশ্লেষণধর্মী উপলব্ধি ভূমিকা রাখতে পারে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনকে অবঃক্ষয়ের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে।
যে কোন ইসলামী বই পেতে ইসলামিক বইঘর.কম এর সাথেই থাকুন
বি:দ্র: ঈমান ও বস্তুবাদের সংঘাত বইটি free pdf download করিতে চাহিয়া লেখকদের নিরুৎসাহিত করিবেন না
Muhammad Abu Abdullah –
ঈমান ও বস্তুবাদের সংঘাত
সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ শেষ যামানার ভয়ানক ফিতনা থেকে বাঁচতে সূরা কাহাফের অনন্যসাধারণ ফযিলত ও গুরুত্বই মূলত লেখককে আকৃষ্ট করে এই সূরা নিয়ে গভীর অধ্যায়ন ও গবেষণা করার জন্যে। সূরা কাহাফই কেন নির্বাচন করা হল? কী এমন বিশেষত্ব এ সূরার যে দাজ্জালের ফিতনা থেকেও বাঁচাতে পারে? এ সূরার অন্তর্নিহিত শিক্ষা থেকে শেষ যামানার উম্মত হিসেবে আমাদের জন্যে কোন কোন মূল শিক্ষা লুকায়িত আছে? দক্ষ ডুবুরি যেমন সাগরতলে ডুব দিয়ে মুক্তো নিয়ে আসে, বিদগ্ধ আলেম সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নাদভী (রাহি) ও ডুব দিয়েছিলেন সূরা কাহাফের ভেতর, নিজ গবেষণালব্ধ মুক্তো সদৃশ শিক্ষাগুলোই লিপিবদ্ধ করেছেন এই বইয়ে। বইটি গতানুগতিক তাফসীরের ঢংয়ে না লিখে লেখক সূরা কাহাফকে মূলত চারটি ঘটনায় ভাগ করেছেন, সেগুলো থেকে শিক্ষা লিপিবদ্ধ করেছেন। এবং দেখিয়েছেন যে, আধুনিক যুগের সবচেয়ে ভয়াবহ ফিতনা হল ভোগবাদ ও বস্তুবাদ। লেখক এ ধরনের কুফরী জীবনদর্শন থেকে পরিত্রাণের পথও বাতলে দিয়েছেন সুনিপুণভাবে।
লেখক পরিচিতিঃ সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী বিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন ইসলামিক চিন্তাবিদ, ঐতিহাসিক, লেখক এবং পন্ডিত ব্যক্তিত্ব। তিনি বিভিন্ন ভাষায় ৫০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি “আলী মিয়াঁ” নামেও পরিচিত। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে আলী নদভী তাঁর রচিত গ্রন্থ মা যা খাসিরাল ‘আলামু বিনহিতাতিল মুসলিমীন (মুসলামানদের পতনে বিশ্ব কী হারালো?)-এর জন্য মুসলিম বিশ্বের নোবেল হিসেবে খ্যাত বাদশাহ ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। পুরস্কারের নগদ দুই লাখ রিয়ালের অর্ধেক তিনি আফগান শরণার্থীদের জন্য এবং বাকী অর্ধেক মক্কার দুটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে (একটি হিফজখানা এবং মাদরাসা আল-সাওলতিয়াহ)দান করে দেন। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাকে সাহিত্যে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ৭ খণ্ডে রচিত উর্দু ইতিহাস গ্রন্থ তারীখে দাওয়াত ওয়া আযীমত (সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস)-এর জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক সেন্টারের পক্ষ থেকে আলী নদভীকে সুলতান ব্রুনাই এ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। যার মূল্য ছিল বিশ লক্ষাধিক ভারতীয় রুপি। আলী নদভী পুরস্কারের সমস্ত অর্থ বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও অসহায়দের মধ্যে বিতরণ করে দেন। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে আলী নদভী দুবাইয়ে তিনি বর্ষসেরা আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যক্তিত্ব নির্বাচিত হন। দুবাইয়ের যুবরাজ এবং আরব আমিরাতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শেখ মুহাম্মাদ ইবনে রুশদের হাত থেকে গ্রহণ করা প্রায় এক কোটি পঁচিশ লক্ষ ভারতীয় রুপি সমমূল্যের এ পুরস্কারের পুরোটা তিনি বিভিন্ন দাতব্য কাজে ব্যয় করেন।
বিস্তারিত পাঠ পর্যালোচনাঃ লেখক সম্পূর্ণ সূরা কাহাফকেই চিত্রায়িত করেছেন ঈমান ও বস্তুবাদের সংঘাতরুপে। সমগ্র বইতে ভোগবাদী দর্শনের অসাড়তা ফুটিয়ে তুলেছেন। বর্ণনা করেছেন শিক্ষা ও উত্তরণের উপায়। সমগ্র সূরাকে মোট চারটি মূল ঘটনায় ভাগ করে তা থেকে মূল শিক্ষা যা বের করেছেন তা অতি সংক্ষেপে নিম্নরুপঃ
১. আসহাবে কাহাফের ঘটনা থেকে শিক্ষাঃ এটি এমন প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক একটি ঘটনা যা মুসলিম-অমুসলিম সকল ঐতিহাসিকগণই সোৎসাহে বর্ণনা ও লিপিবদ্ধ করেছেন। ঈসায়ী ২য় শতাব্দীতে মহাপ্রতাপশালী রোমান নগরী আফিসুসের রাজপরিবারেই বেড়ে উঠে একদল তরুণ, হয় তাওহীদের বিশ্বাসে দীক্ষিত। তখনকার বিশ্বে একত্ববাদী ধর্ম হিসেবে খ্রিস্টীয় ধর্মের অল্প কিছু লোকই টিকেছিলেন, হচ্ছিলেন অমানবিক নির্যাতনের শিকার। এমন সময় রাজপরিবারেরই একদল যুবক রাজার আদেশ অমান্য করে তাওহীদের ঘোষনা দেয়, অস্বীকৃতি জানায় মূর্তিপূজারী বস্তুবাদী সাম্রাজ্যের সকল রসম রেওয়াজকে। ইমান বাঁচাতে গা ঢাকা দেয় গুহার মধ্যে।
সূরাটি যখন নাজিল হয় তখন মক্কার মুসলিমরা নির্যাতিত, নিষ্পেষিত। আল্লাহ যেন আসহাবে কাহাফের ঘটনা বর্ণনা করে তাদেরকে সাহস যোগালেন, জানিয়ে দিলেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার পাথেয়। এই যুবকেরা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করেছিল। অগ্রাহ্য করেছিল চাকচিক্যময় আয়েশী বস্তুবাদী জীবন। ইমানকেই শ্রেষ্ঠ সম্পদ জেনে তা বাঁচাতে গা ঢাকা দিয়েছিল। আল্লাহও তাদের সাহায্য করেন। তিনশত বছরের নিদ্রার পর জেগে তারা আবিস্কার করে, দুনইয়া বদলে গেছে। আগের যুগে যখন তারা ছিল ব্রাত্য, এখন তাদেরকেই মানুষ সসম্মানে ভক্তি করে। যুবকেরা বাহ্যিক উপায় উপকরণ নিয়ে ভাবেনি, সমাজে কিভাবে টিকবে, কয়দিন বাঁচবে, খাবার ফুরিয়ে গেলে কোথায় যাবে এসব চিন্তা তাদেরকে ইমানহারা করেনি। তারা তাওয়াক্কুল করেছিল সেই সত্ত্বার উপর যিনি এসব কিছুরই নিয়ান্তক। তাইতো আল্লাহ তাদের দান করেছেন স্বীয় রাজকীয় ভান্ডার থেকে।
আর এখানেই আছে আমাদের জন্য মূল্যবান শিক্ষা। যখন পার্থিব সব উপায় উপকরণ শেষ হয়ে যায়, তখন কিভাবে ইমান আকিদার উপর টিকে থাকা যায় তার বাস্তবিক উদাহারণ গুহাবাসী এ যুবকেরা। বর্তমান সভ্যতাকে লেখক অভিহিত করেছেন দাজ্জালী সভ্যতা হিসেবে। আমরা বাস করছি চরম বস্তুবাদী ও ভোগবাদী এক জগতে। এখানেও ইমান আকিদা নিয়ে টিকে থাকতে হলে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে আসহাবে কাহাফের যুবকদের মত। আমরা হয়ত হয়ে পড়বো সমাজে ব্রাত্য, অপরিচিত কোন গুরাবা! কিন্তু নিজেদের আকিদা বিশ্বাসে অটল থেকে মালিকের উপর তাওয়াক্কুল করতে হবে। প্রয়োজনে ইমান বাঁচাতে গা ঢাকা দিতে হবে, বেছে নিতে হবে হিজরত। আর নুসরত, মদদ ও যাবতীয় সাহায্যের মালিক তো আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতালাই।
সময় বদলে যায়, যাবেই। এককালের নির্বাসিত আসহাবে কাহাফের যুবকেরাই সময়ের ফেরে পরিণত হয়েছিলেন বীরপুরুষে। বস্তুবাদী সভ্যতার ভিত্তিমূল দুর্বল, এ দর্শনের পরাজয় আর ইমানি শক্তির বিজয় সুনিশ্চিত। প্রয়োজন দৃঢ়তার। প্রাসঙ্গিক তাফসির ছাড়াও লেখক তার আপন ঢংয়ে সূরা কাহাফ নিয়ে অন্য ধর্মের ঐতিহাসিকদের বিবরণ তুলে ধরেছেন, তুলনা করেছেন কোরআনের বর্ণনার সাথে, খুঁজে বের করেছেন শিক্ষা ও মূলনীতি এবং আমাদের জন্য দিয়েছেন দিকনির্দেশনা।
২. দুই বাগিচার মালিকের ঘটনা থেকে শিক্ষাঃ এ ধরনের ঘটনা সমাজে অহরহ ঘটে। নিয়ামতের না শোকরি করে মিথ্যা বড়াইয়ে লিপ্ত হয় কতশত মানুষ! আজকের বস্তুবাদী সমাজে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করার প্রবণতাও যেনো বেড়ে গেছে। অথচ জাগতিক সম্পদ ও ক্ষমতা নশ্বর, ক্ষণস্থায়ী। আমাদের উচিত নিয়ামতের শোকর করা, পরকালকেই প্রাধান্য দেয়া আর যাবতীয় সফলতার কৃতিত্ব জগতসমূহের অধিপতি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকেই দেয়া। নিয়ামতের শোকর করে মাশাল্লাহ বলা, কোনও কাজ করার ইচ্ছা করলে ইনশাআল্লাহ বলা উচিত। কারণ এ কথাগুলো বস্তুবাদী সভ্যতার শিকড়ে সমূলে আঘাত করে এটি জানিয়ে দেয় যে, সকল কিছু আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারেই সম্পাদিত হয়। নচেৎ অহংকারী বাগিচার মালিকের মত আল্লাহ চাইলে নিমিষেই আমাদের সকল সম্পত্তি মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারেন, তখন আমরা তাঁর মোকাবেলায় কোনও সাহায্যকারীও পাবো না।
৩. মুসা ও খিযির আলাইহিস সালামের ঘটনা থেকে শিক্ষাঃ মুসা ও খিযির আলাইহিমুস সালামের বিস্ময়কর মোলাকাত ও তিনটি আজব ঘটনা ও তাঁর ব্যাখ্যা লেখক নাটকীয় ও সংক্ষিপ্ত পরিসরে উপস্থাপন করে তুলে এনেছেন প্রয়োজনীয় শিক্ষা। মানুষ যতই চেস্টা করুক না কেনো, জ্ঞানবিজ্ঞানে উৎকর্ষ সাধন করুক না কেনো, সে এ বিশ্বজগতের অতি অল্প রহস্যেরই জট খুলতে পারবে। এ বিশ্বজগত সম্পর্কে পুরোপুরি অবগতি লাভ করা তো ফেরেশতা বা জিনদের পক্ষেও অসম্ভব, মানুষ তো আরও তাড়াহুড়োপ্রবণ। অনেক সময় আপাতদৃষ্টিতে কোনও জিনিসকে ভুল মনে হতে পারে, কোনও ঘটনাকে খারাপ মনে হতে পারে, কিন্তু হতে পারে তাতে আমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। সব জিনিসের হেকমত ক্ষুদ্র ইলমে জানা আমাদের জন্যে অসাধ্য। মানুষের জ্ঞান, বিবেক, দৃষ্টিসীমা সীমিত ও সংকীর্ণ। তাই আমাদের সবর করা উচিত, আর যাবতীয় কাজের সফলতার জন্যে আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাওয়া উচিত। বস্তুবাদী সভ্যতার অর্জনে আমরা যেন ধোঁকা না খাই।
৪. যুলকারনাইন বাদশার গল্প থেকে শিক্ষাঃ মুমিন বাদশাহ ক্ষমতা পেলে তা দাওয়াতি কাজে ব্যবহার করে। জুলকারনাইন প্রভূত ক্ষমতা ও সাম্রাজ্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রাপ্তি ও অর্জনকে আল্লাহর দান হিসেবেই স্বীকার করেছেন। এ যেন বস্তুবাদী জীবনদর্শনের কফিনে ঠুকে দেয়া হলো শেষ পেরেক। পূর্ব-পশ্চিমের মহা প্রতাপশালী বাদশাহ ও নিজের বড়ত্ব জাহির না করে আল্লাহকেই বড় বলে স্বীকার করলেন, দাওয়াতি কাজে নিবিষ্ট হলেন, ঠিক যেমনটি করেছিলেন নবি সুলাইমান (আ) ও খোলাফায়ে রাশিদাগণ। এ থেকে বিশ্বের সকল শাসকের জন্য নিদর্শন রয়েছে। দাজ্জালকেও ক্ষমতা দেয়া হবে, কিন্তু সে তা ব্যায় করবে সমাজে কুফরি ছড়ীয়ে দিতে। তাই আমরা যেন বস্তুবাদী জীবনদর্শনের মোহে না পড়ি।
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ সমগ্র বইতে সাইয়িদ আবুল হাসান আলি নদভীর ইলমি গভীরতা প্রস্ফুটিত হয়েছে এবং অনেক উপকারী রত্নসদৃশ শিক্ষা লিপিবদ্ধ হয়েছে। অনুবাদকের অনুবাদের ধরন খুবই সুন্দর ছিল। সাবলীল বাক্য রচনা বইর প্রতি মনোযোগ ধরে রেখেছিলো। প্রয়োজনীয় অসংখ্য ফুটনোট ও প্রাসঙ্গিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অনুবাদক ফুটনোটে তুলে এনেছেন যা থেকে অনুবাদককে তারিফ দিতে হয়। তবে অনুবাদক প্রচুর উর্দু শব্দের বাংলায়ন না করায় অনেক সময়ই বাক্যগুলোর সৌন্দর্যমাধুরতা নষ্ট হয়েছে। সম্পাদকের অন্তত উচিত ছিল এই শব্দগুলো বাংলায়ন করে প্রকাশ করা। আশা রাখি, পুনর্মুদ্রণের সময় খেয়াল রাখা হবে।
শেষ কথাঃ এ দুনইয়ার ইতিহাসের পরতে পরতে আছে সত্য মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বের কাহিনী। ঈমান বনাম বস্তুবাদের মোড়কে এই সুপ্রাচীন দ্বৈরথেরই শেষ অধ্যায় রচিত হচ্ছে শেষ জামানায়। এই বস্তুবাদী ও ভোগবাদী জীবনদর্শনের জন্যেই মানুষ দাজ্জালের ফিতনায় পড়ে যাবে। তাইতো সূরা কাহাফ যেন ওই জীবনদর্শনকেই অপনোদন করে দেখিয়ে দিচ্ছে উত্তরণের উপায়। আমরা যেন সবসময় আখিরাতকেই প্রাধান্য দেই। প্রয়োজনে ইমান বাঁচাতে দাজ্জালের ফিতনা থেকে পালাতে আশ্রয় নেয় গুহার ভেতরে। আত্মগরিমা করে নিজেদের বিপদ না ডেকে আনি। যাবতীয় জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও হেকমত তো আল্লাহরই, তাই সকল কাজে আল্লাহকেই প্রশংসা জানাই ও তাঁর কাছেই সাহায্য চেন চাই। দুনইয়ার কোনও রহস্য বুঝে না আসলে আল্লাহর দিকেই যেন নিবিস্ট হই। কাফির তাগুতদের সাহায্য না করি। ঠিক যেমনটি সূরার একদম শেষে বলা হয়েছেঃ
‘ব্যস, যে-ই তাঁর পরওয়ারদিগারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার বাসনা রাখে, তাঁর উচিত সে যেন নেক আমল করে এবং তাঁর রবের ইবাদাতে অন্য কাউকে শরীক না করে।’ [সূরা কাহফঃ১১০]