আমার দেখা পৃথিবী (১ম খন্ড)
‘’দজলা ফুরাতে আছে উন্মত্ত-উদ্ভাসিত তরঙ্গমালার পূর্ব স্বভাব
কিন্তু হায় হেজাজের কাফেলায় শুধু হোসাইনের বড় অভাব’’
সফর শুরু হয় আগ্রহ উচ্ছ্বাস ও আবেগ উদ্দীপনার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে। কল্পনার দোলাচলে দুলতে থাকে গন্তব্যের সৌন্দর্য ও রহস্যের পটভূমি। পাশাপাশি পরিবারের প্রতি থাকে পরম ও কোমল আকর্ষণ। উদ্দীপনা ও আশঙ্কার মাঝেই একজন মুসাফিরের সফর শুরু ও শেষ হয়। সুতরাং একজন মুসলিমের নিরাপত্তা আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ার উপরেই নির্ভর করে। রাসূলের সুন্নাত তরিকায় সফর শুরু করার মাধ্যমেই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া যায়। তাই আল্লামা তকী উসমানী (দা বা) তাঁর রচিত সফরনামা ‘আমার দেখা পৃথিবী’ উম্মতকে সফরের কতগুলো দোয়া শিখানোর মাধ্যমে শুরু করেছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের মাধ্যমে বইটির সূচনা। কাদিয়ানীদের ‘অমুসলিম’ বলা ও তাদেরকে তথাকথিত ‘মানহানি’ করায় কাদিয়ানীরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে কেপটাউনের সুপ্রিমকোর্টে অভিযোগ দায়ের করে। সেই অভিযোগ খন্ডন করার জন্যই আল্লামা তকী উসমানী সাহেবের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর শুরু। সেই সময়ের বিস্তারিত বর্ণ্না ও কাদিয়ানীদের তথাকথিত অভিযোগের খন্ডন ও তাদের অভিযোগের উপর্যুপরি জবাবের বর্ণ্না দেওয়া হয়েছে।
কেপ্টাউনের মোকাদ্দমার কাজ শেষ করে তিনি সৌদি আরব গমন করেন। পবিত্র মক্কায় মহান মালিকের দরবারে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করেন। গোলামের জন্য মহান মালিক ছাড়া আর কে আছে? বান্দার সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা, চেষ্টা-প্রচেষ্টা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই। সেই পরম দয়াবান আল্লাহর কাছে হাজিরা দেয়ার হৃদয়ছোঁয়া বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এই সফরনামায়।
‘তাঞ্জীমে ইসলামী কনফারেন্সে’ যোগদান করে লেখক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন ও সদ্য প্রতিষ্ঠিত ফিকহ একাডেমির জন্য কিছু নীতিমালার প্রস্তাব করেন। তার প্রস্তাবিত নীতিমালা সাদরে গৃহীত হয়।
অতঃপর তিনি মক্কা থেকে ইরাকে গমন করেন। ইরাক ভ্রমণের অভিলাষ লেখকের দীর্ঘদিনের; কেননা পৃথিবী আলোকিত করা মুসলিম জ্ঞানীদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকেন্দ্র ছিল এই ইরাক। ইরাকের কুফা বসরা ও বাগদাদে পদচারণা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম মনীষীদের; তাদের জ্ঞানের আলোয় পৃথিবী আলোকিত হয়েছিল। বর্তমান তথাকথিত ‘আধুনিকতা’ দাবি করা পাশ্চাত্য জগত তাদের থেকে ‘সভ্যতার পাঠ’ নিয়েছিল, কাপড় পরিধান করতে শিখেছি্ল, গোসল করতে শিখেছিল, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সন্ধান পেয়েছিল। শুধু সে কারণেই নয়,ইরাকে আছে জ্ঞানীদের স্বহস্তে লিখিত দুর্লভ পান্ডুলিপি। সেই পাণ্ডুলিপির স্পর্শে নিজেকে আরও আলোকিত করার প্রয়াসেই তার দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা ইরাক ভ্রমণ করা।
ইরাক ছিল সভ্যতা সংস্কৃতির এক আদর্শ নিদর্শন। যখন গোটা পৃথিবী ঘুমিয়ে যেত, বাতি নিভে যেত সমস্ত জনপদের, তখনও ইরাক জ্বলজ্বল করত।জ্ঞানীদের অধ্যায়নের মৃদু আওয়াজ পাওয়া যেত, পৃষ্ঠা উল্টানোর মৃদু শব্দে চারিদিকে সুর মূর্চ্ছনার সৃষ্টি হতো। ইমাম শাফি (রহ) তার সাগরেদ ইউনুস বিন আবদুল আলী কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তুমি কি বাগদাদ দেখেছো? সাগরেদ বললেন, ‘না’, তখন তিনি বললেন ‘তাহলে তুমি তো পৃথিবীই দেখোনি’।
ইরাক ছিল পৃথিবী কাঁপানো শ্রেষ্ঠ রাজা বাদশাহদের আবাসস্থল। শ্রেষ্ঠ মনিষীদের নিয়ে শ্রেষ্ঠ নগরীতে রূপান্তরিত হয়েছিল। দীর্ঘ সাতশত বছর ছিল পৃথিবীর ‘ভাগ্য নির্ধারণের স্থান’ এই ইরাক। তাতারীদের হিংস্র বর্বর আক্রমণে যার পরিসমাপ্তি ঘটে।
আল্লামা তকী উসমানী (দা বা) ইরাক ভ্রমণে বের হন। প্রথমে তিনি শায়েখ আব্দুল কাদের জিলানী এর মসজিদ-মাদ্রাসা মাজার ও গ্রন্থাগারে গমন করেন। গ্রন্থাগারে ইমাম রাগীব ইস্পাহানীর হস্তলিখিত ‘মুফরাদাতুল কোরআন’ গ্রন্থটি দেখতে পান। তার প্রচ্ছদে লেখা, ‘৫৫৬ হিজরীতে গ্রন্থটি দজলা নদীতে পড়ে থাকা অবস্থায় আমি পাই। তাতারীরা গ্রন্থটি সেখানে নিক্ষেপ করেছিল, আমি সেখান থেকে গ্রন্থটি উদ্ধার করি।’- ‘ফকির আবদুল্লাহ বিন মোহাম্মদ বিন আব্দুল কাদির মক্কী’।
এই লেখা পড়ে লেখক হারিয়ে যান সাড়ে সাতশ বছর পূর্বের হৃদয়বিদারক ইতিহাসের মধ্যে, তাতারীরা বাগদাদ দখল করে জনপদ ধ্বংস ও মানুষ হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, সাতশ বছর ধরে রচিত মুসলিমদের জ্ঞানের নির্যাস-বইগুলো দজলা নদীতে নিক্ষেপ করে দজলার রং পরিবর্তন করে দিয়েছিল।
অতঃপর লেখক বিভিন্ন বুযুর্গদের মাজার জিয়ারত করেন ও তাদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন। তারপর প্রাচীন ও আধুনিক কতক গ্রন্থাগার পরিদর্শন করেন।
ইরাক ভ্রমন শেষে লেখক মাদায়েন গমন করেন। মাদায়েনে রাসুলের প্রিয় ছাহাবী হযরত সালমান ফারসী (রা), হযরত হুযায়ফা বিন ইয়ামান (রা), হযরত আবদুল্লাহ বিন জাবের (রা) এর মাজার জিয়ারত করেন ও তাদের জীবনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন। অবশেষে কিসরার রাজপ্রাসাদ, কুফার জামে মসজিদ, প্রশাসনিক কার্যালয় নজফ ও কারবালার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেন।
লেখকের পরবর্তী সফর ছিল নীল নদের দেশ-মিশরে। মিশরের পিরামিড পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এই পিরামিড নিয়ে প্রাচীনকাল থেকে বহুকথা, উপকথা ও কাহিনী রচিত। এর নির্মাণশৈলী, নির্মাণের কারণ, প্রাচীনকালের রচিত কাহিনী বর্ণনার পাশাপাশি আধুনিক যুগের গবেষকদের গবেষণালব্ধ ফলাফল তুলে ধরেছেন।
জিযার পিরামিডের পূর্বদিকে জগদ্বিখ্যাত ‘আবুল হাউস’ পরিদর্শন করেন লেখক। এটা মূলত হারামে আওছাতের প্রতিষ্ঠাতা খাফরের প্রতিকৃতি। তার জীবদ্দশায় সে এটি বানিয়েছিল। মুকরিযী (রহ) এর যুগে এই প্রতিকৃতির শুধু মুন্ড ও গ্রীবা ভূপৃষ্ঠের উপরে দেখা যেত অবশিষ্ট দেহ মাটির নিচে রয়েছে বলে মানুষ ধারণা করত। পরবর্তীতে কোনো একসময়ে মাটি খুঁড়ে এসব ধারণার সত্যতা পাওয়া যায়।
অতঃপর লেখক গোটা আফ্রিকা মহাদেশের প্রাচীনতম মসজিদ হযরত আমর বিন আস (রা) জামে মসজিদ পরিদর্শন করেন। সেই মসজিদের ঐতিহাসিক আলোচনার মাধ্যমে মিশর ভ্রমণের সফরনামা শেষ করেন।
আল্লামা তকী ওসমানী মিশরের সংক্ষিপ্ত সফর শেষে আলজেরিয়া গমন করেন। সেখানে ইসলামিক কনফারেন্সে যোগদান করে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা প্রদান করেন। কনফারেন্স শেষে আলজেরিয়ার প্রাচীন বাজয়া নগরী পরিভ্রমণ করেন।
বসরার দূর্গ, বাবুল বানুদ, আল্লামা আব্দুল হক আশবীলী (রহ) এর মাজার ভ্রমণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনার পাশাপাশি সেসব স্থান ও মণীষীদের জীবনী আলোকপাত করেন। বাজায়ার কনফারেন্স কালেই সুমাম উপত্যকায় ভ্রমণ করেন।সুমাম বাজায়া থেকে আশি মাইল দূরে অবস্থিত একটি গ্রাম।
বাজায়া একসপ্তাহ অবস্থান করার পর লেখক পুনরায় আলজেরিয়া গমন করেন। হযরত উকবা বিন নাফে (রা) এর মাধ্যমে আলজেরিয়ায় ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়। তার বিরত্বগাথার বর্ণনা দেন। তারপর আলজেরিয়ার প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরেন।
আলজেরিয়া সফর শেষে পুনরায় কায়রোতে গমন করেন। কায়রোতে সর্বপ্রথম কায়রোর ঐতিহাসিক মহল্লা ‘রওজা’ ভ্রমণের মাধ্যমে পুনরায় নীল নদের দেশ মিশর ভ্রমণ শুরু করেন। মিশর অবরোধকারী হযরত আমর বিন আশ (রা) এর বীরত্বগাথা ও মিশর জয়ের ইতিহাস তুলে ধরেছেন।
মিশরে লেখক সুলতান সালাউদ্দিন আইউবির দূর্গ, ঝর্ণার প্রাচীর, আল মুকাত্তাম পাহাড়, ইমাম শাফি (রহ) এর মাজার ও ফুস্তাত অঞ্চলে ভ্রমণ করেন।
মিসরের নীলনদের ঐতিহাসিক পটভূমি তুলে ধরেছেন। নীলনদ নিয়ে প্রাচীন মিশরীয়দের দৃষ্টিভঙ্গির অসারতা বর্ণনা করেছেন।
অতঃপর মিশরে অবস্থিত বিখ্যাত মনিষীদের মাজার জিয়ারত করেন এবং তাদের জীবনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে প্রথম খন্ডের সমাপ্তি টানেন।
আল্লামা তকী উসমানীর (দা বা) সফরনামায় ঐতিহাসিক আলোচনার প্রাধান্য বেশি থাকে। তার রচিত সফরনামা শুধু প্রচলিত ধরনের সফরনামাই হয় না; বরং ঐতিহাসিক দলিলও বটে! পৃথিবীর সমৃদ্ধ জনপদগুলোতে পদচারণা দিয়েই ক্ষান্ত হন না তিনি; বরং যুগে যুগে রচিত ইতিহাসের পাঠোদ্ধার করে পাঠক ও পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষার জন্য লিপিবদ্ধ করেন। তাই তাঁর রচিত সফরনামায় পাঠক হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। প্রাচীন ও বর্তমানের সন্ধিক্ষণে পাঠক তালাশ করে মুসলমানদের হারানো ঐতিহ্য,হারানো সংস্কৃতি, হারানো জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রজ্ঞা। স্বচ্ছ আয়নার মত তার সামনে ফুটে ওঠে মুসলমানদের পদস্খলন ও তার ভয়াবহ পরিণতি!
[রিভিউ লেখক : Nesar Uddin Ahmad ]
বি:দ্র: আমার দেখা পৃথিবী (১ম খন্ড) বইটি free pdf download করিতে চাহিয়া লেখকদের নিরুৎসাহিত করিবেন না
Reviews
There are no reviews yet.