লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রি
ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে আমরা খুব বেশি এগুতে পারিনা। প্রফেট, খুলাফায়ে রাশেদীন কিংবা কিছু বিক্ষিপ্ত তথ্যই আমাদের মানসপটে ভেসে উঠে। ধারাবাহিকভাবে ইসলামের হাজার বছরের ইতিহাস আমরা খুব কম মানুষই জানি। তাছাড়া ইসলামের ইতিহাসের অনেক বই একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। সেই বই সাধারণ মানুষ পড়ে মজা পায়না।
এদিক থেকে লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রি খুবই অসাধারণ একটি বই। প্রায় ১৪০০ বছরের ব্যাপক তথ্যবহুল ইতিহাসকে অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে লেখক তুলে ধরেছেন ছোট্ট একটি বইতে। মুসলিম অমুসলিম যারাই ইসলামের ইতিহাসকে খুব সাধারণভাবে জানতে চাইবে তারা এই বইটি পড়তে পারেন।
বইটির লেখক ফিরাস আল খতিব। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর । ইলিয়ন স্টেট ব্রিজ নিউ ইউনিভার্সাল স্কুল শিক্ষকতা করছেন। বর্তমানে শিকাগো দারুল কাসিমে শিক্ষকতায় কর্মরত আছেন। লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রি ফিরাস আল খতিব কে এনে
দিয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতি।
এই বইটি রচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে লেখক বলেন- “মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কে পাঠককে ধারণা দেয়া। বিশেষ করে, সপ্তম শতাব্দীর গােড়ার দিকে ইসলামের পুনঃপ্রবর্তনের পর থেকে আজ পর্যন্ত যা ঘটেছে, তা ইতিহাসের মােড়কে নিয়ে আসাই হলাে এই গ্রন্থ রচনার অন্যতম লক্ষ্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে সেখানকার পাঠ্যপুস্তকে ১৪০০ বছরের ইসলামী ইতিহাসের কিছুই উল্লেখ নেই। লেখক তার ক্লাস গুলোতে ইসলামের ইতিহাসের উপর লেকচার দেয়া শুরু করেন। লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রি মূলত লেখকের টিচিং নোট গুলোর সমষ্টি। ২০১৪ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর থেকেই লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রি আন্তর্জাতিক বাজারে বেস্টসেলারের তালিকায় স্থান করে নেয়।
বইটিতে মোট ১২ টি অধ্যায় রয়েছে। ইসলাম পূর্ব আরব থেকে শুরু করে উনবিংশ শতকের মুসলিম জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে।
বইটির প্রথম অধ্যায়ে প্রাক ইসলামি আরবের ভৌগোলিক অবস্থান বর্ননার পাশাপাশি সে যুগের আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অবস্থার বর্ননা অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে লেখক বর্ননা করেছেন। আরবের ভৌগোলিক অবস্থান বর্ননা করতে গিয়ে লেখক বলেন—“আরবের স্বতন্ত্র ভৌগলিক অবস্থান, জলবায়ু, সংস্কৃতি এবং রাজনীতি সবকিছু মিলে এমন
একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়, যেখান থেকে ইসলাম একটি অনন্য সাধারণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় । সেই সাথে মানব ইতিহাসের যে কোন ধর্ম, আন্দোলন কিংবা সাম্রাজ্য বিস্তারের তুলনায় অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিশালী জীবনদর্শনে পরিণত হয়”।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে রাসূল (সাঃ) এর জীবনী আলোচনা করা হয়েছে। রাসূল সাঃ এর বাল্যকাল, নবুয়ত প্রাপ্তি, ইসলাম প্রচার, কুরাইশদের অত্যাচার, মদীনায় হিজরত, রাসূলের মাদানী জীবন, গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধসমূহ এবং রাসূলের অন্তিম সময়ের বর্ননা রয়েছে।
তৃতীয় অধ্যায়ে ৬৩২-৬৬১ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়কালের বর্ননা রয়েছে। রাসূলের ওফাতের পরে নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে যে সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল সে মুহুর্তে হযরত আবু বকর রাঃ খলীফা নির্বাচিত হন। এভাবে হযরত উমর রাঃ (৬৩৪-৬৪৪), হযরত উসমান রাঃ(৬৪৪-৬৫৬), হযরত আলী রাঃ (৬৫৬-৬৬১) এর খেলাফত কালের বর্ননা রয়েছে।
বইটিতে আলী এবং মুয়াবিয়া রাঃ এর মধ্যকার দ্বন্ধ নিয়ে তেমন আলোচনা না করে লেখক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। আলী রাঃ এর শাহাদাতের মধ্য দিয়ে ইসলামের ইতিহাসে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগের সমাপ্তি ঘটে। শুরু হয় নতুন যুগ…….
চতুর্থ অধ্যায়ঃ এই অধ্যায়ে উমাইয়া খেলাফতের আলোচনা হলেও লেখক এর নাম দেন মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। চতুর্থ অধ্যায়ের প্রারম্ভেই লেখক খেলাফতের অবসান এবং হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর ক্ষমতায় আরোহনের বিষয়টি তুলে ধরেন। ইসলামের ইতিহাসের এই অধ্যায়টি একটু জটিল। কিন্তু লেখক বিতর্ক এড়িয়ে সুকৌশলে ইতিহাসই উপস্থাপন করেছেন। লেখক বলেছেন —
খারিজীদের হাতে হযরত আলী রাঃ -এর নির্মম শাহাদাত এবং পরবর্তীকালে খিলাফতের দায়িত্বে যখন হযরত মুয়াবিয়া রাঃ ছাড়া আর কারও নাম আসার মতাে পরিস্থিতি থাকল না, তখন থেকেই মূলত খােলাফায়ে রাশেদা যুগের অবসান হয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। ৬৬১ থেকে ৬৮০ সাল পর্যন্ত হযরত
মুয়াবিয়া রাঃ শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার সময়ে মুসলিম সাম্রাজ্য এবং সমাজ-কাঠামাের আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। তিনি যখন দায়িত্ব নেন, তখন মিশর থেকে শুরু করে ইরান পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় মুসলিমদের মধ্যে বিভক্তি আর বিভাজন ছড়িয়ে পড়েছিল। সে বিভাজন আরও নেতিবাচক হয়ে মুসলিম সাম্রাজ্যকে সামগ্রিকভাবে চূড়ান্ত পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারত। হযরত আমীর মুয়াবিয়া -এর রাজনৈতিক দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রভাব সেই পতনের হাত থেকে মুসলমানদের রক্ষা করেছিল । কিন্তু একই সঙ্গে
এটাও সত্য যে, তার কিছু সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম বিতর্কের সূচনা করেছিল। যা থেকে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ফাটল ধরে যায় এবং তা আজও অব্যাহত রয়েছে। হযরত মুয়াবিয়া -এর শাসন থেকে উমাইয়া খিলাফতের সূচনা
হয়, যে ব্যবস্থায় পরবর্তী শাসক নির্বাচনের ক্ষেত্রে পারিবারিক উত্তরাধিকারী হওয়াটাই একমাত্র যোগ্যতা বা মানদন্ড হিসেবে নির্ধারিত হয়ে যায়। উমাইয়া।
খিলাফত ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এরপর শুরু হয় মক্কার আরেক পুরানে প্রভাবশালী গোত্র আব্বাসীয়দের নেতৃত্বে আব্বাসীয় খিলাফত।
উমাইয়া আমলেই মুসলিম এলাকার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। লেখক এখানে সাম্রাজ্যবাদ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। স্পেন থেকে ভারত পর্যন্ত মুসলিম খেলাফতের বিস্তৃতি ঘটে। ভারত বর্ষে মুহাম্মদ বিন কাসিম এবং স্পেনে তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালিত হয়। এতদ অঞ্চল মুসলিম শাসনাধীনে আসে এই সময়।
উমাইয়াদের শাসনের অবসান ঘটে ৭৫০ সালে। তাদের হঠিয়ে দৃশ্যপটে চলে আসে আব্বাসীয়রা। শুরু হয় এক নবযুগের।
পঞ্চম অধ্যায়ঃ এই বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো এই চ্যাপ্টারটি। ইসলামের ইতিহাসের এই যুগটিকে বলা হয় The golden age of the Islamic civilization. বুদ্ধিবৃত্তিক সোনালী যুগের অসাধারণ বর্ননা করেছেন লেখক এই অধ্যায়ে।
সপ্তম আব্বাসীয় খলিফা আল মামুন (৮১৩-৮৩৩) দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞান এবং যুক্তিবিদ্যা ছাড়া কাঙ্ক্ষিত সােনালি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আর বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষতাকে উপভোগ করতে হলে সাম্রাজ্যের নানা স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানগুলােকে একটি স্থানে নিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই। তিনি জানতেন, মুসলিম সাম্রাজ্যের সব জ্ঞানী ও
স্কলারকে এক জায়গায় এনে যদি তাদের পারস্পরিক মত-বিনিময় করার সুযােগ দেয়া যায়, তাহলে সম্ভাবনার অনেক দুয়ার এমনিতেই খুলে যাবে।
জ্ঞানের এই অপরিহার্যতার কথা বিবেচনায় নিয়ে খলিফা আল মামুন বাগদাদে একটি অনন্য সাধারণ শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলেন। এর নাম ছিল বায়তুল
হিকমাহ বা হাউজ অব উইজডম | বাংলায় বলা যায় জ্ঞানের বসতবাড়ি। এর গঠন ও কাজের প্রকৃতি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী; বর্তমান সময়ের প্রচলিত শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানের সাথে এর কোন মিল ছিল না। এই শিক্ষা কেন্দ্রের আওতায় একই ক্যাম্পাসে একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়, পাঠাগার, অনুবাদ কেন্দ্র এবং গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এই আমলে মুসলিমরা জ্ঞানবিজ্ঞানে চরম উৎকর্ষ সাধন করে। গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল, চিকিৎসা বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান সহ জ্ঞানের প্রতিটি সেক্টরে মুসলিমরা অবদান রাখেন। লেখক বিস্তারিত ভাবে মুসলিমদের সেই অবদান গুলি তুলে ধরেছেন।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে ইসলামী জ্ঞান চর্চার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আকীদাহ, হাদীস সংকলনের ইতিহাস, সিহাহ সিত্তার রচনা সহ ইসলামী জ্ঞান চর্চার বিভিন্ন বিষয় আলোকপাত করা হয়েছে।
সপ্তম অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে বিভিন্ন মুসলিম অঞ্চল সমূহের উত্থান পতন নিয়ে। ৯০৯ খ্রীস্টাব্দে ওবায়দুল্লাহ আল মাহদীর নেতৃত্বে ফাতেমীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠা, সেলজুক ও বুহাইদ বংশের উত্থান। সবশেষে মোঙ্গলদের হাতে বাগদাদের পতনের ইতিহাস বিবৃত হয়েছে।
অষ্টম অধ্যায়ে আরেকটি সোনালী যুগের তথা আন্দালুসিয়ার ইতিহাস বর্ননা করা হয়েছে। কর্ডোভা ও গ্রানাডায় উমাইয়াদের যে জ্ঞান বিজ্ঞান কেন্দ্রীক উন্নয়ন তা অত্যন্ত সুন্দরভাবে লেখক তুলে ধরেছেন।
নবম অধ্যায়ে আফ্রিকায়, ভারতবর্ষে, চীনে, মধ্য এশিয়ায় ইসলামের ইতিহাস বর্ননা করা হয়েছে।
তেরশতকের দিকে এসে মুসলিম সাম্রাজ্য প্রকৃত অর্থেই পতনের দ্বারপ্রান্তে এসে গিয়েছিল। অযোগ্য নেতৃত্ব, সামরিক অলসতা, ধন সম্পদের উপর বিলাসিতা কারণে বহিঃশক্তির আক্রমণ প্রতিহত করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল তারা। ঠিক সেই মুহুর্তেই ওসমান বের নেতৃত্বে মুসলিমদের আরেকটি শক্তির উত্থান ঘটে। সেই ওসমানীয়দের ইতিহাসের বর্ননা করা হয়েছে দশম অধ্যায়ে।
উনবিংশ শতাব্দীতে সমগ্র বিশ্বব্যাপী সংকট দেখা দেয়। সেই সংকটের মুখোমুখি হয় ওসমানীয় খেলাফত। ১৯২৪ সালে অবসান ঘটে এই খেলাফতের। জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। বৃটিশ উপনিবেশের হাত থেকে অন্যান্য অঞ্চল গুলো স্বাধীনতা লাভ করতে থাকে। বলা যায় উনবিংশ শতকের ইসলামের ইতিহাসের বর্ননা করা হয়েছে একাদশ অধ্যায়ে।
শেষ অধ্যায়ে নতুন এবং পুরাতন চিন্তাধারা নিয়ে আলোকপাত করেছেন লেখক।
প্রায় ১৪০০ বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস খুব সুন্দরভাবে অল্প কথায় তুলে ধরেছেন লেখক।
রিভিউ লেখেছেনঃ Hafiz Ahmad Milon
বি:দ্র: লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রি (ইসলামের হারানো ইতিহাস) বইটি free pdf download করিতে চাহিয়া লেখকদের নিরুৎসাহিত করিবেন না
Reviews
There are no reviews yet.