রঙিন মখমল দিন
অনন্য গদ্যশৈলীর জাদুকর শরীফ মুহাম্মদ লিখেছেন তাঁর মখমল রঙিন শৈশবের আত্মজীবন। স্মৃতি হাতড়ে তুলে এনেছেন ফেলে আসা জীবনের হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ, স্বপ্ন-উৎকণ্ঠা। দরদে তড়পানো এক ঘোরলাগা গদ্যে বয়ান করেছেন সব, দুরন্ত শৈশবের সকল কিছু। ব্যক্তিত্বের আড়ালে ঘুমিয়ে থাকা এক শিশু খলবলিয়ে কথা বলেছে স্মৃতির বারান্দায় দাঁড়িয়ে। রঙিন মখমল দিন
রঙিন মখমল দিন অতীতের রেহালে স্মৃতি সাজিয়ে একে একে বলে গেছেন তাঁর মায়ার শহর ময়মনসিংহের রোদেলা সকাল, ঘুরন্ত শহরের অলি-গলি, প্রথম পাঠ, পড়ালেখার জন্য ঢাকায়, মায়ের বিরহে আত্মরোদন, টুকরো প্রেম, কিংবদন্তির সাক্ষাৎ এবং আলো হাতে ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর এক সদ্যকিশোরের জীবনযাপন।
এ যেন কিছুটা আত্মজীবন, অনেকটা শৈশব…!
শরীফ মুহাম্মদ-এর মখমলরঙা শৈশবে আপনাকে স্বাগতম!
রঙিন মখমল দিন
বি:দ্র: রঙিন মখমল দিন বইটি free pdf download করিতে চাহিয়া লেখকদের নিরুৎসাহিত করিবেন না
Jubayer Mohiuddin –
প্রিয় লেখকের বইয়ের প্রকাশ সব সময়ই একটা নিরব বা সরব অপেক্ষার অবসান ঘটায়। তবে বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সাহিত্যিক শরীফ মুহাম্মদের রঙিন মখমল দিন আমার কাছে একটা যুগের অবসান করে দিলো। শৈশবের কওমী মাদরাসাকে নিয়ে এভাবে স্মৃতিচারণের জায়গাটা শূন্য ছিলো। একজন প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় লেখকের ছোটবেলার গল্প বলতে আল মাহমুদের যেভাবে বেড়ে উঠি, সৈয়দ হকের তিন পয়সার জ্যোৎস্না থেকে নিয়ে ওপার বাংলার প্রতিভা বসুর জীবনের জলছবি কিংবা ভিরা ব্রিটেনের টেস্টামেন্ট অব উইথের গল্পগুলির রেশ অনেকদিন বাকি থাকলেও এসব শৈশব কিংবা কিশোর বেলার গল্পের সাথে কেনো যেনো ঠিক নিজেকে খুঁজে পেতাম না। কওমিপড়ুয়া একজন পাঠক হিসেবে এমন একটা কিশোর আত্মজীবনীগ্রন্থ পাঠ্য-পিপাসায় অনুভূত হয়েছে যেখানে থাকবে আমারই গল্প। বইয়ের পৃষ্ঠার কালো কালো অক্ষর ছাপিয়ে ভেসে উঠবে আমারই কিশোরকাল, কাঁচাবাজারের দোকানে পানি ছিটিয়ে সতেজ করে রাখা সবজির মতোই থকথকে আমার দূরন্ত মক্তবে ঝুলে ঝুলে পড়তে থাকা আরবি হরফ ঊনত্রিশটি, মাখরাজ সতেরোটি…। একবসায় পড়ে ফেলা রঙিন মখমল দিনের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় আমার শৈশবকালকে দেখি যেনো অন্তহীন একটা পথ, পিছনে পড়ে আছে বৃষ্টিস্নাত রেললাইনের মতো।বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কূল নেই। কিনারা নেই। আলোর খোঁজে একটা জীবন পিছে থেকে যায়। শরীফ মুহাম্মদের শৈশবের আত্মজীবনীতে কুয়াশার ভেতর মানুষের অস্পষ্ট নড়াচড়ায় নিজেরে আবিষ্কার করি। একটি অপাপবিদ্ধ কিশোরের করূণ মুখ। শরতের শেষ দুপুরের আকাশের মতো একটা সাদা টুপি আর নীল পাঞ্জাবী পাজামা পরিহিত কিশোর পৃথিবীর কোন এক ক্লেদহীন সকালে বাবার হাত ধরে মক্তবে যাচ্ছে। আরো পিছনে একটা মায়ের মুখ দেখা যায়। পথেরবাঁকে।হাত নেড়ে আমাকে বিদায় দেয়। আমার মায়ের নরম ঘোমটার আড়ালের হাস্যোজ্জ্বল চোখমুখে সেদিনের সেইস্বপ্ন- “ছেলে আমার একদিন জগতের সবচেয়ে বড় আলেম হবে।”
রঙিন মখমল দিনের পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় এসব আবেগের মাঝেও আমরা দেখি আমাদের শৈশব ও কৈশরের স্মৃতির প্রাঙ্গণ কওমি মাদরাসাকে নিয়ে শরীফ মুহাম্মদের সময়োপযোগী ইতিবাচক কি দুর্দান্ত উপস্থাপন! বিভিন্ন ডকুমেন্টারি ফিল্ম, টিভি রিপোর্টে যখন কওমি মাদরাসাকে গোঁড়া, অনুন্নত ও প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মনীতিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তখন রঙিন মখমল দিনে আমি শিরোনাম খুঁজে পাই, “তারবিয়াতের সোনালি ধারা” নামে আমারই জীবন থেকে খসে পড়া কোন তারার গল্প, যেই গল্পের প্লট নির্মিত হয় কওমি মাদরাসায় দুষ্টুমি করে কোন উস্তাদের কাছে ধরা খাওয়ার মুহূর্তের ভয় ও শঙ্কা নিয়ে। বইটি পড়ে শৈশব ও কৈশরের এসব কঠিন ও ভীতিকর মুহূর্তগুলো জীবনের এডভেঞ্চার টাইপ ফ্যান্টাসি হয়ে উঠলো আজ! এই বইয়ের পাঠ অনুভূতি লিখতে বসে নিজের শৈশব আর কৈশরের সেই দুরন্ত দিনগুলোর কথা মনে পড়লে তারাশঙ্করের কবির মতো জিহ্বায় উচ্চারিত হয় আমার ফেলে আসা কওমি জীবন নিয়ে, “আহা! জীবন এতো ছোট কেনে?”
রঙিন মখমল দিনে সমকালীন ও অতীত হয়ে যাওয়া বড় বড় আলেম ও বুযুর্গদের কথা এসেছে। বয়সের ভাড়ে নুয়ে পড়া হাফেজ্জী হুজুর থেকে নিয়ে এইতো সেদিন রহমাতুল্লাহি আলাইহির মিছিলে যোগ দেওয়া পাহাড়পুরী হুজুরের গল্পের মাঝে আমি খুঁজে পাই আমার কৈশর। রঙিন মখমল দিন পড়তে বসে আমার স্পষ্ট দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে উঠলে আমি দেখি, বিশ্বাসী ও আস্থার একটি হাত আমাকে নিয়ে বসিয়ে দিচ্ছেন একজন দৃশ্যমান ফেরেশতার সামনে। বই কিংবা সমাজের ভাষায় এই মানব ফেরেশতার নাম দিয়ে থাকি আমরা “বড়হুজুর।” বড় বড় হুজুরদের একটুখানি সংস্পর্শের সেই নিরব ও মুগ্ধ সময়ে স্বচ্ছ কাঁচের গা বেয়ে তিরতিরিয়ে নেমে আসা পানির মতো মসৃণ ও অপার্থিব অনুভব নতুন করে সৃষ্টি হয় শরীফ মুহাম্মদের এই বই থেকে।
বর্তমান সময়ে শিল্পের বোধ ও চর্চার প্রতি ব্যাকুলতা নিয়ে বেড়ে উঠা কওমি প্রজন্মের জন্য রঙিন মখমল দিন একটি প্যাটার্ন তৈরী করে দেয়। আমাদের মাদরাসাপড়ুয়া কিশোর সাহিত্যপ্রেমীদের পাঠ কেমন হওয়া উচিত কিংবা নিরাপদ সেই প্যাটার্জ ধরতে পারি বইয়ের একদম শেষ দিকে শরীফ মুহাম্মদের কিশোরকালের গল্পে তিনি যখন পুরো মজমার ভিড় থামিয়ে মাওলানা ফরীদ মাসুদ সাহেবকে সাহস করে বলে উঠেন,
“আমি তো লেখতে চাই। সাহিত্য করতে চাই। আমি কি গল্প উপন্যাস পড়তে পারবো না? শরৎচন্দ্র পড়তে পারবো না? আমাকে তো মানা করা হয়। পড়তে ভয় পাই। ”
ফরীদ মাসুদ উত্তর দিলেন, ‘তোমার এখন যে বয়স সব উপন্যাস তুমি পড়তে পারবে না। বড়দের সঙ্গে কথা বলে বলে পড়বে। উপন্যাসে তো অনেক কিছুই থাকে। সেসব তোমার উপযোগী নয়। আবার অনেক কিছু পড়তেও পারবে। ফরিদ মাসুদ সাহেবের সাথে কথা শেষে ভিড় এগিয়ে যায়। শরীফ মুহাম্মদ সাহেব একপাশে সরে দাঁড়িয়ে থাকে একটা ঘোরের ভিতর। বিস্ময়ের ঘোর। একজন বড় লেখক-সাহিত্যিকের সঙ্গে দেখা হওয়ার বিস্ময়। তিনি পায়ে স্যান্ডেল চাপিয়ে বইয়ের ভাষায় ‘দিগ্বিজয়ী ভঙ্গি’তে বের হয়ে আসেন। বই শেষ হয় এর পরের পৃষ্ঠায়। মুগ্ধতায় মোহাবিষ্ট হয়ে আমি প্রশ্ন করি নিজেকে, একজন শরীফ মুহাম্মদ কি শুধু সেদিনই দিগ্বিজয়ী ভঙ্গিতে বের এসেছিলেন নাকি সেদিন থেকেই শুরু তার এই দিগ্বিজয়ী পথচলা?
***
ইসলামী বইয়ের পাঠক, কওমি মাদরাসা, মক্তবের স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা প্রতিটি বাঙালি পাঠকের জন্যই রঙিন মখমল দিনটি একটি সুখপাঠ্য হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এছাড়াও যারা ইসলাম ও সুন্দরের সেবায় সাহিত্য চর্চা করতে ইচ্ছুক তাদের জন্যও বইটি পড়া খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।