সুখের মতো কান্না
সুখের মতো কান্না
ধারাবাহিক উপন্যাস
[একটি চিরন্তন ঘটনার দূরবর্তী ছায়া অবলম্বনে]
এক
পরপর তিনরাত একই স্বপ্ন দেখল রুহান।
স্বপ্নের শেষ পর্যায়ে এসে তার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙার পর সে আবিষ্কার করে তার সারা শরীর ভেজা। যেন এইমাত্র ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে অবস্থা। তখন প্রচণ্ড তৃষ্ণা পায় তার। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমের রমজান মাসে বিকেল চারটার দিকে যেভাবে বুক শুকিয়ে যায়, মনে হয় একফোঁটা পানি না হলে কলিজা ফেটে মরেই যেতে হবে_তেমন তৃষ্ণা।
আজ তৃতীয়বারের মতো স্বপ্নটা দেখল রুহান। রাত তখন তিনটা বাইশ। পরপর তিন গ্লাস পানি পান করল সে। স্বপ্নটিকে একটু নাড়াচাড়া করতে লাগল। এমন অদ্ভুত স্বপ্ন কেন দেখবে সে? আর এর মানেই-বা কী হতে পারে?
নিজে নিজে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চেষ্টা করল সে। এমনও তো হতে পারে যে, তার অবচেতন মন পুরো ব্যাপারটি কল্পনা করে সাজিয়ে নিয়েছে; তারপর স্বপ্নের মোড়কে ভরে সেটাকে সামনে এনে উপস্থাপন করেছে—ঘুমের মধ্যে।
এই ব্যাখ্যাকে সে নিজে নিজেই বাতিল করে দিলো। এ-জাতীয় পরিকল্পনার জন্য প্রথমে বিষয়টিকে সামনে আসতে হবে। সেটা বাস্তবে হোক অথবা কল্পনায়। তারপর সেটিকে নিয়ে ভাবতে হবে। তাহলেই হয়তো এক সময় ভাবনাগুলো শেকড় গেড়ে বসবে মনের ভেতরে। তারপর স্বপ্নের মাধ্যমে অস্তিত্ব তৈরি করে ঘুমের মধ্যে এসে হাজির হবে। রুহান তো এ-জাতীয় চিন্তা-ভাবনার ধারে-কাছেও যায়নি কখনো। সুতরাং এ ব্যাখ্যা বাতিল।
আরেকটি সম্ভাবনাও থাকতে পারে, আসলে এর কোনো ভিত্তিই নেই। তার দুর্বল চিত্ত তাকে বিভ্রান্ত করবার চেষ্টা করছে। তাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাইছে। আর এই চেষ্টাটা করছে বিপরীত অ্যাঙ্গেল থেকে।
একজন মানুষকে দুভাবে কাবু করা যায় :
এক. বেশি কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে;
দুই. স্বাভাবিকেরচে বেশি খুশি করে ফেলার মাধ্যমে।
দুটি পদ্ধতিই মোটামুটি খতরনাক।
একলোক, তার যা কিছু ছিল, জমি-জমা, বাড়ি-ঘর, সবকিছু বিক্রি করে ব্যবসা করার জন্য (মনে করা যাক) ৫০ লক্ষ টাকা একত্র করেছে। এখন যদি ছিনতাইকারী তার সব টাকা নিয়ে যায়, তাহলে এই লোকের হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
একইভাবে নুন আনতে পানতা ফুরোয় টাইপ গরিব কাউকে যদি হঠাৎ এককোটি টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়, অথবা ‘যদি লাইগ্যা যায়’, তাহলে এই লোকেরও মাথার তার ছিড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
মানুষ অতি সুখ বা অতি দুঃখ_ কোনোটাই নিতে পারে না। মাত্রাতিরিক্ত কষ্ট বা আনন্দ_দুটোই বিপজ্জনক। দুভাবেই মানুষকে ঘায়েল করা যায়।
রুহান ভাবছে তার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পদ্ধতিই অবলম্বন করা হয়ে থাকতে পারে। নাগালের বাইরের কিছু তার সামনে তুলে ধরে তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হতে পারে।
অবশ্য এই সম্ভাবনাও পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারল না সে। ব্যাপারটি এমন হলে পরপর তিনরাত একই ব্যাপার ঘটত না। কাকতালীয় বলেও মেনে নেওয়া যায় না। কারণ, কাকতালেরও একটা তাল থাকে।
তাহলে কী হতে পারে?
রুহানের বাবার নাম রায়হান চৌধুরী। ধর্মকর্ম করা মানুষ। তবে ধর্মের যে-কোনো তত্ত্ব তাঁর সামনে রাখা হলে তিনি সেটাকে যুক্তির পোশাক পরিয়ে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা রাখেন। ‘স্বপ্ন’ ব্যাপারটি নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণধর্মী ভাবনাগুলোও যথেষ্ট যৌক্তিক হয়।
রুহানের বয়স নয়। অথচ তার চিন্তা-ভাবনা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা বড়দের মতো। যে-কোনো ব্যাপারকে যুক্তির কষ্টি পাথরে যাচাই করে বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা ছোট্ট রুহান পুরোপুরিই রপ্ত করে ফেলেছে। বাবা জীবিত থাকতেই বাবার এই গুণটি সে পেয়ে গেছে উত্তরাধিকার সূত্রে।
সেদিন বাবার মুখে রুহান শুনেছে, স্বপ্ন মোট তিন প্রকারের হয়।
১. সত্য স্বপ্ন
স্রষ্টা মানুষকে মাঝে-মধ্যে স্বপ্নে বিভিন্ন ইঙ্গিত করেন। অনেক সময় বিপদ-আপদের জন্য আগাম সতর্ক করে দেন। বেশিরভাগ মানুষই সেটা বুঝতে পারে না। তারা স্বপ্নকে নিছক স্বপ্ন ভেবে হালকা করে উড়িয়ে দেয়।
২. অসত্য স্বপ্ন
মিস্টার ইবলিস বলে ভয়াবহ ক্ষমতাবান এক ভদ্রলোক আছেন। উনার আরেক নাম আজাজিল। উনি মানুষের রগে-রেশায় বিচরণ করার ক্ষমতা রাখেন। এই ক্ষমতাও তিনি স্রষ্টার কাছ থেকে চেয়ে এনেছেন। ঘটনাটি ছিল এভাবে_
আল্লাহপাক যখন মানুষ সৃষ্টি করলেন। তখন ইবলিস ছিল ফেরেশতাদের কাতারে। আল্লাহ বললেন, ‘সবাই আদমের সামনে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে মাথা নত করো। আমার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে তোমরা সম্মান করো।’
সবাই সম্মান করল, শুধু ইবলিস যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল, সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। আল্লাহপাক বললেন,
-‘কী হল? তুমি আদমকে সম্মান করছ না কেন?’
ইবলিস বলল, ‘আমি তো আদমকে মাথা নত করে সম্মান জানাতে পারি না।’
আল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন?’
সে বলল, ‘আমি যে তাঁর থেকে শ্রেষ্ঠ।’
আল্লাহ বললেন, ‘ও আচ্ছা, তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ।’
‘কীভাবে?’
সে বলল, ‘মানুষকে আপনি সৃষ্টি করেছেন মাটি দিয়ে। আর মাটির গুণ হলো নিম্নমুখী। একখণ্ড মাটিকে উপর দিকে ছুড়ে মারলে সেটা আবার নিচে নেমে আসে। আর আমাকে তৈরি করেছেন আগুন দিয়ে। আগুন হলো ঊর্ধ্বমুখী। সুতরাং আমি আপনার আদম থেকে শেষ্ঠ।’
আল্লাহ বললেন, ‘তাহলে তুমি আদমকে সম্মান জানাবে না?’
শয়তান বলল, ‘স্যরি আল্লাহ। আমি সেটা পারব না।’
-‘আমার নির্দেশ অমান্য করার পরিণাম তুমি জানো?’
-‘হ্যাঁ, জানি।’
-‘তবুও তুমি তোমার সিদ্ধান্তে অনড়?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘তবে যাও। দূর হয়ে যাও আমার সামনে থেকে। চিরদিনের জন্য তোমার গলায় অভিশাপের মালা পরিয়ে দেওয়া হলো।’
শয়তান বুঝে গেল তার যা হবার হয়ে গেছে। আল্লাহর মুখ থেকে কোনো কথা একবার বেরিয়ে গেলে সেটার আর নড়চড় হয় না।
সে বলল,
-‘ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমি তো হাজার হাজার বছর আপনার উপাসনা করলাম। বিনিময়ে আমি কি আপনার কাছে কিছু চাইতে পারি না?’
আল্লাহ বললেন, ‘কী চাও তুমি?’
সে বলল, ‘মানুষকে কুমন্ত্রণা দেওয়ার ক্ষমতা।’
-‘আর?’
-‘তাদের অন্তরে প্রবেশ করার ক্ষমতা।’
-‘আর?’
-‘কিয়ামত পর্যন্ত আয়ু।’
-‘আর?’
-‘সুস্থতা। স্থায়ী সুস্থতা।’
-‘আর কিছু?’
-‘আর কিছুর দরকার নেই আমার। এতেই যথেষ্ট হবে।’
আল্লাহ বললেন, ‘কী যথেষ্ট হবে?’
শয়তান বলল, ‘যে মানব জাতির জন্য আজ আমার এই দুর্গতি, আমি সেই জাতিকে শান্তিতে থাকতে দেবো না। সবগুলোকে আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুলব। সবাইকে আমার দলে ভিড়াব।’
আল্লাহ বললেন, ‘তাই নাকি?’
শয়তান বলল, ‘হ্যাঁ।’
আল্লাহ বললেন, ‘আমি তোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। দেখি তুই কতটুকু কী করতে পারিস। তবে একটি কথা মনে রাখিস, যারা আমার প্রকৃত বান্দা হবে, তুই তাদের ধারে-কাছেও ভিড়তে পারবি না। আর যারা তোর কুমন্ত্রণায় ভ্রান্ত পথে পা বাড়াবে, আমি তাদেরও তোর সাথে জাহান্নামের সঙ্গী বানাব’…
… সেই থেকে ইবলিস শয়তান মানুষের মনের ভেতরে, শরীরের শিরা-উপশিরায় বিরাজ করার ক্ষমতা নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সে মানুষের ভেতরে প্রবেশ করে মানুষকে নষ্ট করার যাবতীয় কলাকৌশল প্রয়োগ করে। মাঝে-মধ্যে স্বপ্নেও মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। রুহান ভাবছে তার স্বপ্নে শয়তানের কোনো হাত আছে কি না।
সুখের মতো কান্না
বি:দ্র: সুখের মতো কান্না বইটি free pdf download করিতে চাহিয়া লেখকদের নিরুৎসাহিত করিবেন না
Reviews
There are no reviews yet.