সাদ্দাম হোসাইন : জীবনের শেষ দিনগুলি
সাদ্দাম হোসাইন। ইরাকের সাবেক এই প্রেসিডেন্ট তাঁর মৃত্যুর এক দশকের বেশি সময় পরও বিশ্বময় আলোচিত এবং সমালোচিত হয়ে আছেন। দীর্ঘমেয়াদে ইরাক শাসনকালে শাসক হিসেবে তাঁর কার্যক্রমের নিন্দা এবং প্রশংসা, দুটোই হয়েছে বেশ। কিন্তু একজন মানুষ হিসেব কেমন ছিলেন তিনি? নবপ্রকাশ-এর প্রকাশিত এ বইয়ে মিলবে সেই উত্তর।
বইটির আগাগোড়া পাঠে পাঠক সাদ্দাম হোসাইনের এমন এক রূপ ও চরিত্র সম্পর্কে জানতে পারবেন, যা আজ অবধি সবার আড়ালে রয়ে গেছে। এই বইয়ের লেখক একজন মার্কিন সেনা, তিনি নিজের চোখে সাদ্দাম হোসাইনকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। বন্দী হওয়ার পর থেকে ফাঁসির কাষ্ঠে সমর্পণ পর্যন্ত ধীরে ধীরে তাঁর নিজের এবং সহকর্মীদের কাছে কীভাবে শ্রদ্ধা ও সম্মানের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন বন্দী সাদ্দাম হোসাইন, সেই বর্ণনা পুরো বইয়ে পাঠককে মোহগ্রস্ত করে রাখবে। তেমনি সন্দেহ নেই, হৃদয়বান পাঠক এই বই পাঠে সাদ্দাম হোসাইনের মানবিক রূপ দেখে বিগলিত হবেন।
বি:দ্র: সাদ্দাম হোসাইন : জীবনের শেষ দিনগুলি বইটি free pdf download করিতে চাহিয়া লেখকদের নিরুৎসাহিত করিবেন না
Nasima –
সাদ্দাম হোসাইন : জীবনের শেষ দিনগুলি
রবার্ট বন্দুক চালনা শিখতে এসেছে একাডেমিতে। জর্জিয়ায় সবচেয়ে ভালো বন্দুকচালনা নাকি এখানেই শেখায়। বন্দুক চালনা আর ট্যাকটিক্যাল ট্রেনিং এর দায়িত্বে আছেন মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য স্টিভ হাচিনসন। স্টিভের সাথে দেখা হতেই চমকে গেল রবার্ট, মনে হচ্ছিল এনাকে আগে কোথাও দেখেছে সে। স্টিভের হাতের ঘড়ি দেখে এক মুহূর্তেই চিনে গেল সে। এই স্টিভ হাচিনসন যে সে কেউ না, বরং ইরাকের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেইনের কারাবরণকালীন সময়ে তাকে পাহারা দেয়া স্পেশাল-১২ এর অন্যতম সদস্য, যে কীনা সাদ্দাম হুসেইনের ফাঁসির রায় কার্যকর হবার পর ইস্তফা দিয়েছিল আমেরিকান সেনাবাহিনী থেকে।
হ্যালো স্টিভ, আমি রবার্ট। আমি তোমাকে টিভিতে দেখেছি। আমি জানি তুমি কে!- বলে উঠলো রবার্ট। স্টিভ রাখঢাক না রেখেই বলল- হ্যাঁ, তুমি যা ধারণা করছ আমি সে ই। রবার্ট কিছুটা অবাক হল আর জানতে চাইলো- স্টিভ তুমি কি আমাকে বলবে কেন তুমি সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দিয়েছিলে? এই হাতের ঘড়িটাও কিন্তু আমি চিনি। স্টিভ কিছুটা ভারী স্বরেই বলল- আমাকে কেউ এভাবে সরাসরি কখনো জিজ্ঞেস করে নি রবার্ট, তোমার সাহস দেখে ভালো লাগলো। আমি বলবো তোমাকে কী হয়েছিল আমার সাথে, কী দেখেছিলাম আমরা! আমি বলবো…
ইরাকের কাছে ব্যাপক মানববিধ্বংসী রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র রয়েছে এমন মিথ্যা অভিযোগ দাঁড় করায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। তাদের নেতৃত্বাধীন বাহিনী ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে সাদ্দামের বাহিনী পরাজিত হয়। সাদ্দাম হুসেইন আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু তাকে আটক করা হয় তার জন্মস্থান তিকরিতের এক বাঙ্কার থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের জৌলুস যার চেহারায় চিকচিক করতো সে সাদ্দামকে আমাদের কাছে নিয়ে আসা হয় শ্মশ্রুমণ্ডিত, ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত অবস্থায়।
ইরাকের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন সাদ্দাম হুসেইনের বিচার করছে তখন আমাদের ১২ জন সেনা সদস্য অর্থাৎ স্পেশাল ১২ কে দায়িত্ব দেয়া হয় সাদ্দাম হুসেইনকে সর্বাক্ষণিক পাহারা দেয়ার। দীর্ঘদিন আমাদের সুযোগ হয় সাদ্দাম হুসেইনের সাথে থাকার। আমার সাথে ছিল বার্ডেনওয়ার্পার, রজারসনসহ অনেকেই। সে সময়ের কিছু ঘটনাই তুলে ধরি আমাদের ভাষ্যে-
রজারসন বলতেন- “আমরা কখনও সাদ্দামকে মানসিক বিকারগ্রস্ত হত্যাকারী হিসাবে দেখিনি। তাঁর দিকে তাকালে নিজের দাদুর মতো লাগত অনেক সময়ে।” ইরাকের জেলে জীবনের শেষ সময়টুকু কাটানোর সময়ে সাদ্দাম হোসেন আমেরিকান গায়িকা মেরি জে ব্লাইজার গান শুনতেন নিয়মিত। নিজের এক্সারসাইজ বাইকে চড়তে পছন্দ করতেন সাদ্দাম। ওটার নাম দিয়েছিলেন ‘পনি’। মিষ্টি খেতে খুব ভালবাসতেন। মাঝেমধ্যেই মাফিন খেতে চাইতেন।
আমরা তাকে জানিয়েছিলাম যে তাঁর ভাই মারা গেছেন। যে সেনাসদস্য খবরটা দিয়েছিলেন, সাদ্দাম তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “আজ থেকে তুমিই আমার ভাই।”
আরেকজন প্রহরীকে বলেছিলেন, “যদি আমার সম্পত্তি ব্যবহার করার অনুমতি পাই, তাহলে তোমার ছেলের কলেজে পড়তে যা খরচ লাগবে, সব আমি দিতে রাজী।”
এক রাতে বছর কুড়ি বয়সের সেনা প্রহরী ডসন বাজে মাপে কাটা একটা স্যুট পড়ে ঘুরছিল। জানা গেল যে ডসনকে ওই স্যুটটা সাদ্দাম উপহার হিসাবে দিয়েছেন।
“বেশ কয়েকদিন আমরা সবাই ডসনকে নিয়ে হাসাহাসি করছিলাম ওই স্যুটটার জন্য। ওটা পড়ে ও এমন ভাবে হাঁটাচলা করত, যেন মনে হতো কোনও ফ্যাশন শো’য়ে ক্যাটওয়াক করছে ডসন।”
সাদ্দাম আর তাঁর প্রহরীদের মধ্যে বন্ধুত্ব বেশ ঘন হয়ে উঠছিল, যদিও তাদের ওপরে কড়া নির্দেশ ছিল যে সাদ্দামের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টাও যেন কেউ না করে।
স্টিভ হাচিনসন এবার নিজের কথা বলে ওঠে- সাদ্দাম হুসেইন তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন যে তার ফাঁসি হবে না। কিন্তু যেদিন তার ফাঁসির রায় হল সেদিন তিনি যেন ভেঙে পড়লেন। তিনি চুপচাপ গোসল করে ফাঁসির জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। তাকে নিয়ে যাবার আগে তিনি আমাকে ডাক দেন তার সেলের সামনে। তার হাতের রেমন্ড ওয়েইল হাতঘড়িটা আমাকে পরিয়ে দেন, আমি গাইগুই করলে তিনি কিছুটা জোরই করেন। তিনি জানতে চেয়েছিলেন আমাদের টিমের বাকিরা ঘুমাচ্ছে নাকি!
সাদ্দামের ফাঁসির পর তার মরদেহ বাইরে নিয়ে আসা হলে আমরা সবাই মিলে অবাক হয়ে দেখলাম মানুষজন তার মরদেহের ওপর থুথু ছিটাচ্ছে। আমরা অনেকেই সেটা দেখে চোখের পানি থামাতে পারি নি। আমি তো অনেককে গিয়ে হাতজোড় পর্যন্ত করেছি এমনটা না করতে। বাকিরা আমাকে আটকাচ্ছিল বারবার কারণ আমাদের ওপর কড়া নির্দেশ ছিল সাধারণ মানুষদের সাথে সংঘর্ষে না যেতে। আমি এসবকিছু মিলিয়ে আসলে মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়ি তাই সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমি জানিনা ইরাক স্বাধীন হয়েছে সে যুদ্ধের পর নাকি হয়নি, আমি জানিনা সাদ্দাম হুসেইনের মৃত্যু সঠিক ছিল না ভুল, আমি শুধু ব্যক্তি সাদ্দামকে সামনাসামনি দেখেছি। তাই আমার কথা থেকে কোন সিদ্ধান্তে যাবার মানে হয় না।
না, আমরাও কোন সিদ্ধান্তে যাব না। কিন্তু সাদ্দাম হুসেইনের শেষের সেই দিনগুলোর কথা তো জানাই যায়। একসময়ের প্রবল শক্তিধর এই নেতা কীভাবে কারাগারের অন্ধকার কুঠুরিতে কবিতা লিখে, বাগান করে, মুক্তি পাবার স্বপ্ন দেখে পার করেছেন সে গল্প তো জানার মতোই।